আমাদের সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ
১. সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ হলেন সেই ব্যক্তি যিনি সর্বপ্রথম খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত বাংলা অঞ্চলের জনপদসমূহকে একত্রিত করে এই বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডকে "বাঙ্গালাহ" (বাংলা) নামে অভিহিত করেন।
২. তিনি এই অঞ্চলের একই ভাষাভাষী ও নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অধিবাসীদেরকে 'বাঙ্গালি' (বাঙালি) হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং এই সময় থেকেই পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মানুষ বাংলার অধিবাসীদের বাঙালি পরিচয়ে চিনতে শুরু করে। এভাবেই বিশ্বের বুকে বাঙালি জাতির স্বতন্ত্র জাতিগত পরিচয়ে পরিচিতি প্রদান করেছিলেন সুলতান ইলিয়াস শাহ।
৩. ইলিয়াস শাহ নিজেকে 'শাহ-ই-বাঙ্গালিয়ান' (বাঙালি জাতির শাহ) ও 'শাহ-ই-বাঙ্গালাহ' (বাংলার শাহ) ঘোষণা করেছিলেন। ইলিয়াস শাহের পূর্বে বাংলার কোনো শাসক কখনো নিজেকে বাংলার শাসক ঘোষণা করেন নি। রাজা শশাঙ্ক, পাল সম্রাটগণ ও সেন রাজারা নিজেদেরকে আখ্যায়িত করতেন 'গৌড়রাজ বা গৌড়েশ্বর হিসেবে'।
৪. সুলতান ইলিয়াস শাহ বাংলাকে এতোটা ভালোবাসতেন যে, একটি নদীর নামই তিনি দিয়েছিলেন 'বাঙ্গালি', যা আজও বহমান।
৫. প্রাচীন বাংলার বিখ্যাত বৌদ্ধ শহর বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনীর জনৈকা হিন্দু বিধবা ব্রাহ্মণ পুষ্পবতী ভট্টাচার্যকে বিবাহ করেন সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি পুষ্পবতীর নাম দেন 'ফুলওয়ারা বেগম'। ইলিয়াস শাহ্ স্ত্রী ফুলওয়ারা বেগমের নিকট থেকেই বাংলা শিখেছিলেন এবং বাংলা ভাষা শেখার পর তিনি স্ত্রীকে ডাকতেন 'ফুলমতি' নামে। ফুলমতি বেগমের গর্ভেই জন্মগ্রহণ করেন সুলতান ইলিয়াস শাহের সুযোগ্য পুত্র সুলতান সিকান্দার শাহ।
৬. তিনি বাংলার রাজধানী গৌড় থেকে পান্ডুয়ায় স্থানান্তরিত করেছিলেন এবং রাজধানী ফিরোজাবাদ (পান্ডুয়া) কে পরিণত করেছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের অত্যন্ত সমৃদ্ধ নগরীতে। তিনি প্রাচীন বাংলার সমৃদ্ধ গৌড় নগরীর পুনর্নির্মাণও করেছিলেন।
৭. ফিরোজাবাদে তিনি নির্মাণ করেছিলেন ২৭ টি হাম্মামখানা বিশিষ্ট বিখ্যাত সাতাশঘড়া প্রাসাদ।
৮. তিনিই সেই ইলিয়াস শাহ, যাঁর মুকুটে শোভা পেত পৃথিবীর দ্বিতীয় মূল্যবান হীরা- ''দরিয়া-ই-নূর''।
৯. তিনি প্রথম রাজভাষা হিসেবে বাংলার মর্যাদা দেন এবং ফার্সির পাশাপাশি বাংলাকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ব্যবহার শুরু হয় সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহের হাত ধরে।
১০. তিনি প্রথম ও একমাত্র মুসলিম শাসক যিনি নেপাল বিজয় করেছিলেন।
১১. ১৩৩৮ সালে তিনি সাতগাঁওয়ের শাসনক্ষমতা দখল করে নিজেকে রাঢ়ের স্বাধীন সুলতান ঘোষণা করেন এবং ''শামস আদ দুনিয়া ওয়া আদ দ্বীন আবু আল মুজাফফার ইলিয়াস শাহ'' উপাধি ধারণ করে দিল্লি সালতানাত থেকে পৃথক করে নিজেকে রাঢ়ের স্বাধীন সুলতান ঘোষণা করেন।
১২. ১৩৪২ সালে তিনি গৌড় আক্রমণ করেন এবং গৌড়ের সুলতান আলাউদ্দিন আলী শাহকে পরাজিত করে গৌড় দখল করে গৌড়ের সুলতান হিসেবে অধিষ্ঠিত হন।
১৩. ১৩৪৪ সালে তিনি ত্রিহুত বিজয় করেন ।
১৪. ১৩৫০ সালে গৌড়ের সুলতান ইলিয়াস শাহ্ নেপালে অভিযান পরিচালনা করেন এবং নেপালের রাজা জয়রাজ মল্লকে পরাজিত করে কাঠমুণ্ডুর পতন ঘটান। জয়রাজ মল্ল বীরত্বের সাথে লড়াই করেও শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে পলায়ন করেন।
১৫. তিনি ১৩৫০ সালে কাঠমুণ্ডুর পতন ঘটিয়ে শম্ভূনাথ মন্দির আক্রমণ করেন এবং পূর্বপ্রতিজ্ঞা অনুসারে শম্ভূনাথের মন্দির ধ্বংস করেন।
[সুলতান ইলিয়াস শাহ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যে পশুপতিনাথের সামনে এত নিরীহ মানুষকে বলি দেয়া হলো তার মূর্তি আমি নিজ হাতে ভাঙবো।]
১৬. সেসময় শৈবপ্রধান নেপালে শিবপূজাকে কেন্দ্র করে এক বিকৃত যৌনাচার উৎসব শুরু হয়েছিলো।
এই বিকৃত কামাচারকে উৎখাত করার নিমিত্তে ইলিয়াস শাহ কাঠমুণ্ডুর সকল শৈব উপাসনালয় জ্বালিয়ে দেন। কিন্তু সুলতান ইলিয়াস শাহ বৈষ্ণবদের আক্রমণ করেন নি এবং তাদের মন্দিরেরও কোনো ধরনের ক্ষতি করেন নি। বৈষ্ণবদের মন্দিরসমূহ সম্পূর্ণ নিরাপদ ছিলো।
১৭. শম্ভূনাথ মন্দির থেকে ৩০০ মণ খাটি সোনা ও প্রচুর ধন-রত্ন লাভ করে রাজধানীতে ফিরে আসেন সুলতান।
১৮. ১৩৪৯ সালে বঙ্গের সুলতান ফখরউদ্দিন মোবারক শাহ ইন্তেকাল করেন এবং তাঁর পুত্র ইখতিয়ারউদ্দিন গাজী শাহ সোনারগাঁওয়ের সিংহাসনে বসেন। ১৩৫২ সালে সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ ইখতিয়ারউদ্দিন গাজী শাহের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন এবং তাঁকে বিতাড়িত করে সোনারগাঁও দখল করেন।
১৯. তিনি ১৩৫২ সালে গৌড় ও বঙ্গ একত্রিত করে তাঁর সাম্রাজ্যের নামকরণ করেন "বাঙ্গালাহ" এবং এভাবেই গোড়াপত্তন ঘটে স্বাধীন বাংলা সালতানাতের।
২০. সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহের পূর্বে মুসলিম শাসকেরা কেবলমাত্র মুসলিমদেরই সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দিতেন। কিন্তু ইলিয়াস শাহ যোগ্য হিন্দুদের মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে উচ্চ রাজপদে নিয়োগ দান করেন।
২১. ১৩৫১ সালে মুহাম্মাদ বিন তুঘলকের মৃত্যুর পর দিল্লির সুলতান হন তাঁর চাচাত ভাই ফিরোজ বিন রজব। ১৩৫৩ সালে হিন্দুস্থানের সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক বাংলার সুলতান ইলিয়াস শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করলে ইলিয়াস শাহ তাঁর দুর্ভেদ্য দিনাজপুরের একডালা দুর্গে সপরিবারে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ফিরোজ শাহ তুঘলক একডালা দুর্গ অবরোধ করে ব্যর্থ হন এবং বর্ষাকাল চলে আসলে হিন্দুস্থানী সৈন্যরা প্রতিকূল পরিবেশে টিকতে না পেরে ইলিয়াস শাহের সাথে সন্ধি করে ফিরোজ শাহ তুঘলক দিল্লি ফিরে যান।
২২. সুলতান ইলিয়াস শাহের আধিপত্য ছিলো বেনারস পর্যন্ত, তিনি ১৩৪৫ সালে হিন্দুরাজ্য ছোটনাগপুর বিজয় করেন এবং ছোটনাগপুরকে বিহারের সাথে জুড়ে দেন। তিনি গোন্দওয়ানা রাজ্য বিজয় করেন এবং উড়িষ্যার বিস্তৃত অঞ্চল অধিকারে আনেন।
২৩. সুলতান ইলিয়াস শাহের সেনাপতি ছিলেন একজন হিন্দু ব্যক্তি, নাম শাহদেব। ১৩৫৩ সালে দিল্লিশ্বর ফিরোজ শাহ তুঘলক বাংলা আক্রমণ করলে বাংলার সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শাহদেব।
২৪. উপমহাদেশের একমাত্র হাজ্বী শাসক হলেন সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ। তাই তাঁর নামের পূর্বে সবসময় "হাজ্বী" শব্দটি যুক্ত ছিলো। [সে যুগে পবিত্র হজ্বব্রত পালন এখনকার মতো এতোটা সহজ ছিলো না। ইলিয়াস শাহই ভারতীয় উপমহাদেশের একমাত্র শাসক যিনি হজ্ব পালন করেছিলেন।]
২৫. সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ ১৩৫৬ সালে কামরূপ বিজয় করেন। উল্লেখ্য যে, কামরূপের কামাখ্যা মন্দিরে বহুকাল ধরে এক অশ্লীল ও নোংরা উপাসনা পদ্ধতি প্রচলিত আছে। সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ যখন কামরূপ বিজয়ের পরিকল্পনা করেছিলেন তখন কামাখ্যা মন্দিরের কুসংস্কারাচ্ছন্ন পূজারীদের ধারণা ছিলো, এই যৌনি মূর্তির কারণেই নাকি ইলিয়াস শাহ কামরূপ বিজয় করতে পারবেন না। কিন্তু ইলিয়াস শাহ ১৩৫৬ সালে রাজধানীর পতন ঘটিয়ে কামরূপ বিজয় করে তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।
২৫. কিছু সূত্রমতে, তাঁর আধিপত্য বেনারস নয়, বিস্তৃত ছিলো উত্তর প্রদেশের সুদূর বাহরাইচ পর্যন্ত।
একের পর এক যুদ্ধাভিযানের ফলে ১৩৫৭ সালের শেষদিকে সুলতানের শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে এবং রাজধানী ফিরোজাবাদ ত্যাগ করে তিনি চলে আসেন তাঁরই পুনর্নির্মিত ঐতিহাসিক গৌড় নগরীতে। ১৩৫৮ সালের জানুয়ারি মাসে গৌড় দুর্গেই মহান প্রতিপালকের ডাকে সাড়া দিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সুলতান। তাঁকে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিহারের হাজিপুর শহরে সমাধিস্থ করা হয়।
সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ চলে যান সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে, কিন্তু রেখে যান তাঁর প্রতিষ্ঠিত উপমহাদেশের অন্যতম ধনী ও শক্তিশালী সাম্রাজ্য- বাংলা সালতানাত।
আজ বাঙালি মুসলমান আজ তাঁর অতীত জৌলুস, বীরত্বগাঁথা ভুলে আত্মপরিচয়সংকটে জর্জরিত।
লেখক: রাজিত তাহমীদ জিত
সোর্স:
তারিখ-ই ফিরোজশাহী- জিয়াউদ্দিন বারাণী
তাবাকাত- ই নাসিরী - মিনহাজ-উস-সিরাজ
মধ্যযুগে বাংলা- খন্দকার স্বনন শাহরিয়ার
হাজার আফসারী
সিরাত-ই ফিরোজশাহী
SISB (Sultan Ilyas Shah Bangalah) Foundation
ফ্রান্সিস বুকাননের লেখা
বাংলার ইতিহাস: সুলতানী আমল - আব্দুল করিম
R. D. Banerji. বাঙ্গালার ইতিহাস (in Bengali). Vol. 2. pp. 145–146.
Abdul Karim (1959). Social History of the Muslims in Bengal (Down to A.D. 1538
Author: Rajit Tahmid Jeet
Historical General 25-October-2022 by east is risingশাহী বাঙ্গালা সালতানাতে অসংখ্য সুদক্ষ সুলতান ও বীর সেনাপতির আগমন ঘটেছে। তবে আসাম থেকে উড়িষ্যা পর্যন্ত কিংবদন্তিতে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে বাংলার যে সেনানায়কের নাম, তিনি হলেন কালাপাহাড়। সাহিত্য কিংবা সিনেমা, লোকমুখে প্রচলিত মিথ বা কিংবদন্তি সব কিছু ছাপিয়ে যাঁর নাম আজও বিখ্যাত হয়ে রয়েছে যে মহান বীরের নাম, তিনি আর কেউ নন, তিনিই কালাপাহাড় । কে ছিলেন কালাপাহাড়? কেনই বা তার নামে এতো কিংবদন্তী তুল্য উপাখ্যান?
আজ আলোচনা করবো সে কথাই, আজ আলোচনা করতে চলেছি "বঙ্গ রক্ষক" কালাপাহাড় সম্পর্কে।
কালাপাহাড় বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী মতান্তরে নওগাঁ জেলার বীরজোয়ান গ্রামে সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ভাদুড়ি বংশের সম্ভ্রান্ত বারেন্দ্রী ব্রাহ্মণ। তাঁর বাল্যনাম ছিলো রাজীবলোচন রায় মতান্তরে কালাচাঁদ রায়- ডাকনাম ছিলো রাজু। রাজু ভাদুড়ী হিসেবেই পরিচিত ছিলেন কালাপাহাড়। তাঁর পিতা নয়নচাঁদ রায় ছিলেন বাংলার সুলতানের অধীনস্থ ফৌজদার। অকালে পিতৃহারা হয়ে রাজীবলোচন রায় ভাদুড়ি ভাগ্যের সন্ধানে সুলতান সুলায়মান শাহ'র সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই মেধা ও সমরকুশলতায় সুলতান ও অন্যান্য পদস্থ কর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে উচ্চপদে নিযুক্তি লাভ করেন। ধর্মপ্রাণ ব্রাহ্মণ ছিলেন রাজু,, নিয়মিত বিষ্ণুপূজা করতেন। সুদর্শন কালাপাহাড়ের সাথে সুলায়মান শাহ কারলানীর সুন্দরী কন্যা দুলারী বিবির প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দুলারী বিবি পিতার কাছে কালাপাহাড় কে বিবাহ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কালাপাহাড় শাহজাদীকে বিবাহ করার জন্য ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হন ও মুহাম্মাদ ফর্ম্মুলী নাম ধারণ করেন। কালাপাহাড়ের সাথে দুলারী বিবির শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়। তিনি অচিরেই সুলায়মান শাহ'র প্রধান সেনাপতি পদ লাভ করেন।
কালাপাহাড় মুসলিম হওয়ায় বর্ণবাদী উগ্র ব্রাহ্মণ সমাজ তাকে সমাজচ্যুত করে । তিনি ইসলাম গ্রহণের পরও তাঁর বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-পরিজনের সাথে সৌহার্দ্য বজায় রাখবার চেষ্টা করলেও ধর্মান্তরের কারণে হিন্দু সমাজ তাঁকে পরিত্যাগ করে, বারংবার তাঁকে অপদস্থ হতে হয়।
এমতাবস্থায় নিজ জাতি কর্তৃক অপমানে জর্জরিত হয়ে শেষমেশ তিনি মায়ের পরামর্শে পদ-পদবী, ক্ষমতা, প্রিয়তমা নবপরিণিতা স্ত্রীর ভালোবাসা , রাজবংশের জামাতার সম্মান, জীবন-মৃত্যুর ভয়, শাস্তি সবকিছু উপেক্ষা করে প্রায়শ্চিত্তের জন্য পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে গমন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু জগন্নাথ ধামের পুরোহিতরা তাকে অত্যন্ত জঘন্য ভাষায় অপমান করে তাকে দেবালয়ে প্রবেশ করতেই দেয় নি। ব্রাহ্মণ্যবাদী উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা অপমানিত-অপদস্থ হয়ে কালাপাহাড়ের মনে হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে তীব্র বিদ্বেষের সৃষ্টি হয়। ধীরে ধীরে হিন্দু রীতি-নীতি সম্পর্কে তাঁর মনে জন্ম নেয় তীব্র ঘৃণা। তিনি প্রচণ্ড হিন্দু ধর্মবিদ্বেষী হয়ে ওঠেন...…।
বাংলায় তখন চলছে পাঠান কারলানী রাজবংশের শাসন, তান্ডার সিংহাসনে আসীন সুলতান সুলায়মান শাহ্ কারলানী (রহ.)
উড়িষ্যার সিংহাসনে তখন পরাক্রমশালী সম্রাট মহারাজ গজপতি হরিচন্দন মুকুন্দদেব। গজপতি হরিচন্দন মুকুন্দদেবের একের পর এক আক্রমণ আসছে দক্ষিণ ভারতীয় সালতানাত ও বাংলার উপর। তান্ডা দখলের অভিপ্রায়ে বারবার সপ্তগ্রামে আক্রমণও করেছেন উড়িষ্যারাজ। এইভাবে শাহী বাঙ্গালাহ্'র সার্বভৌমত্ব তখন উড়িয়া গজপতিদের কাছে হুমকির মুখে। বাংলা সালতানাত বারবার হুমকির মুখে পড়ছে উড়িয়া হিন্দুদের। উড়িয়াদের একের পর এক হানায় বাংলার মুসলিম সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। বাংলার মুসলিম শাসনকে রক্ষার জন্য মুশরিক শক্তির বিরুদ্ধে আবির্ভূত হলেন যে মহামানব, তিনিই কালাপাহাড়।
১৫৬৪-৬৫ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আকবরের বশ্যতা স্বীকার করে নেন ও উড়িষ্যার গজপতি হরিচন্দন মুকুন্দদেব গৌড় আক্রমণ করে গঙ্গার তীরে অবস্থিত সপ্তগ্রাম অধিকার করে নেন। ১৫৬৫ সালে ত্রিবেনীর যুদ্ধে পরাজিত হলেন সুলায়মান শাহ কারলানী, সন্ধি করতে বাধ্য হলেন মুকুন্দদেবের সাথে।
বাদশাহ আকবর যখন মেবারের শিশোদীয় রাজপুতদের সঙ্গে দীর্ঘকাল যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন, সুলায়মান শাহ ১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দে উড়িষ্যা আক্রমণ করেন। মুকুন্দদেব কোটসামা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করলে সুলায়মান শাহ্ কালাপাহাড়ের অধীনে ময়ূরভঞ্জের অরণ্যসংকুল পথে উড়িষ্যা আক্রমণ করতে সৈন্য পাঠান।
এইসময় মুকুন্দদেব তার এক বিদ্রোহী সামন্তের হাতে নিহত হন, এর ফলে ওই বিদ্রোহী সামন্ত এবং রঘুভঞ্জ ছোটরায় উড়িষ্যার সিংহাসন দখল করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু উভয়েই কালাপাহাড় কর্তৃক পরাজিত ও নিহত হন।
১৫৬৮ সালে মহাপরাক্রান্ত সম্রাট গজপতি মুকুন্দদেবকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও পৃথিবী থেকে গজপতিদের সমূলে উৎখাত করে চিরস্থায়ীভাবে উড়িষ্যা বিজয় করেন কালাপাহাড়। এরপর ১৫৭৬ সালে রাজমহলের যুদ্ধে সম্রাট দাউদ শাহ্ কারলানীর পরাজয়ের পর্যন্ত আর কখনো উড়িষ্যা বাংলা সালতানাতের হাতছাড়া হয় নি!
উড়িষ্যা জয় করে কালাপাহাড় উপস্থিত হলেন পুরীর কুখ্যাত জগন্নাথ মন্দিরে। দেবালয়ে প্রবেশ করেই পূর্বের স্মৃতি মনে পড়লো কালাপাহাড়ের। ইসলাম গ্রহণের অপরাধে কী নিদারুণ যাতনা ভোগ ও অপমানের শিকারই না হতে হয়েছিলো তাঁকে!! কেউ তাকে গ্রহণ করেনি,কেউ না! বাংলার ব্রাহ্মণ্যবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত মহাবীর কালাপাহাড়।
প্রতিশোধ গ্রহণের তীব্র স্পৃহা ও ব্রাহ্মণ্যবাদী বিভাজনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন কালাপাহাড়। জগন্নাথ মন্দিরে প্রবেশ করে গরুর চামড়ার বিশাল ঢোল হাতে নিয়ে বাজাতে লাগলেন। ঢোলের তীব্র শব্দে মন্দিরের বিগ্রহগুলো খসে খসে পড়তে লাগলো। বাঙ্গালীবীরের তীব্র ঢোলের আওয়াজে ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তির অন্তরাত্মা ক্রন্দন করে উঠলো। এককালে অপমানিত হয়েছিলেন যেই মন্দিরে, সেই জগন্নাথ মন্দির তছনছ করে দিলেন কালাপাহাড়। উড়িষ্যার সকল মন্দিরে ধ্বংসযজ্ঞ চালালেন তিনি। ময়ূরভঞ্জের মন্দির, কোনার্কের সূর্য মন্দিরের সকল দেবালয় উপড়ে ফেলেন কালাপাহাড়।
জগন্নাথ নামে কথিত দেবতার মূর্তি চিল্কা হ্রদে নিক্ষেপ করলেও
জগন্নাথের কোনো অভিব্যক্তি দৃশ্যমান হলোনা!
তিনি কোচরাজ বিশ্বসিংহের পুত্র বিখ্যাত সমরনায়ক শুক্লধ্বজ কে পরাজিত ও বন্দি করেন এবং কোচরাজ্যসহ কামরূপের তেজপুর পর্যন্ত অধিকার করে বাঙলার অন্তর্ভুক্ত করেন ।
কালাপাহাড়ের মন্দির ধ্বংসের কৌশল ছিলো অন্য রকম। তিনি দেবালয়ে প্রবেশ করে একটি গরুর চামড়ার তৈরি ঢোল নিয়ে প্রচন্ড শব্দে বাজাতেন। সেই বিকট আওয়াজে প্রতিমাগুলো খসে খসে পড়তো। এই আওয়াজ মু-শ-রি-ক রাজশক্তির বিরুদ্ধে ইসলামের রাজনৈতিক বিজয়ঘোষণাস্বরূপ।
অতঃপর সমস্ত ধন-রত্ন লুট করে কালাপাহাড় চলে যেতেন।
কালাপাহাড়ের আসাম জয়ের সময় ইতিহাসের এক অভিনব পুনরাবৃত্তি ঘটে। প্রায় দুই শতাব্দী পূর্বে ১৩৫৬ সালে শাহ-ই-বাঙ্গালিয়ান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের কামরূপ জয়ের সময় আসামের কামাখ্যা মন্দিরের সীতাযোনীপূজারীরা ধারণা করেছিলো, তাদের পূজ্য সীতাযোনীর কারণেই ইলিয়াস শাহ কামরূপ দখল করতে পারবেন না , তাদের সেই ধারণা সেদিন ব্যর্থ হয়েছিলো....কালাপাহাড়ের আসাম অভিযানেও তারা একই চিন্তা করলো যে, সীতাযোনিমূর্তির জন্যই কালাপাহাড় আসামের কিছুই করতে পারবেন না। এবারো পূজারীদের আশায় নিরাশ হতে হলো। গাজী কালাপাহাড় কামাখ্যা মন্দিরে ভাঙচুর চালালেন...
সুলায়মান শাহ-এর মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র বায়াজিদ শাহ সিংহাসনে বসলেও আমির ওমরাহ তার অযোগ্যতার কারণে তাঁ কে হটিয়ে কনিষ্ঠ পুত্র দাউদ শাহ কররানীকে সিংহাসনে বসান। দাউদ শাহ-এর সার্বক্ষণিক সহচর ছিলেন কালাপাহাড়।
রাজমহলের যুদ্ধ:
১৫৭৫ সালের তুর্কাইয়ের যুদ্ধে দাউদ শাহ্ পরাজিত হলে বিহার-বাংলা মুঘলদের অধীনে চলে যায়, কররানী দের নিয়ন্ত্রণে থাকে কেবল উড়িষ্যা। কিন্তু তান্ডায় প্লেগ ছড়িয়ে পড়লে ৫০০০ সৈনিক ও ১৫ জন সেনাপতিসহ সুবাদার মুনিম খান মৃত্যুবরণ করলে এই সুযোগে কালাপাহাড় কে সঙ্গে নিয়ে উড়িষ্যা থেকে গৌড় পর্যন্ত প্রতিটি দুর্গ অধিকার করেন দাউদ শাহ। অন্যদিকে দাউদ শাহর ডানহাত ভাটির রাজা ঈসা খাঁ তাঁর শক্তিশালী নৌবহর দিয়ে হামলা চালিয়ে পূর্ববাঙলাকে মুঘল নিয়ন্ত্রণমুক্ত করেন।
আকবর খান জাহান হোসেইন কুলী খান তুর্কমান কে পাঠান দাউদ শাহকে দমনের জন্য। বাবা খান কাকশাল,ইসমাইল বেগ, জান বাহাদুর বাহসুতী, রাজা গোপাল, রাজা তোডরমল, শাহাম খান, কিয়া খান, মোজাফফর হোসেন খান তুর্বাতী প্রমুখ বড় বড় মানসাবদারদের নিয়ে ৯১ হাজার সৈন্যসহ রাজমহলের প্রান্তরে গঙ্গার তীরে উপস্থিত হয় মুঘল বাহিনী। দীর্ঘ আটমাস তোপযুদ্ধে কেউ কারোর ক্ষতি করতে না পারলেও ১১ই জুলাই রাতে বিশ্বাসঘাতক কুতলু খান লোহানি মুঘলদের জানিয়ে দেয়- সাইফ-ই-পাখতুন ফৌজ জুনায়েদ খান কররানী আজ প্রচন্ড গরমের কারণে সেনাশিবিরের বাইরে চারপায়ার উপরে ঘুমুচ্ছেন। সঠিক জায়গায় তোপ দাগে মুঘল ফৌজ। গোলার আঘাতে উড়ে যায় জুনায়েদ খান কররানীর একটি পা।
পরের দিন ১২ই জুলাই বিশ্বাসঘাতক শ্রী হরি ও কুতলু খান লোহানির প্রেরিত তথ্যের ভিত্তিতে মুঘলরা গঙ্গানদী পেরিয়ে বাংলার বাহিনীকে আক্রমণ করতে সক্ষম হয়।
বাবা খান কাকশাল অতর্কিতে কালাপাহাড়কে আক্রমণ করে বসেন। কালাপাহাড় বাবা খান কাকশালের বাহিনীকে বিধ্বস্ত করে দেন।
সবাই ভেবেছিলো প্রচন্ড আহত হওয়ায় জুনায়েদ খান যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। কিন্তু সবাই হতবাক হয়ে দেখলো, একটি পা উড়ে যাবার পরেও জুনায়েদ হাতির পিঠে চড়ে লড়াই করছেন ও বিহারের মুঘল সুবাদার মোজাফফর হোসেন খান তুর্বাতীর বাহিনীকে বিধ্বস্ত করে দেন। কিন্তু ক্রমশ প্রচন্ড রক্তক্ষরণ হতে থাকলে হাওদাপৃষ্ঠে লুটিয়ে পড়েন জুনায়েদ, শহীদ হলেন সাইফ-ই-আফগান ফৌজ জুনায়েদ খান কররানী। তাঁর মৃত্যুতে বাংলার পরাজয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়।
এমন ক্রান্তিকালে রণাঙ্গন ছেড়ে নিজেদের বাহিনীসহ চলে যায় কুতলু খান লোহানী ও শ্রী হরি বিক্রমাদিত্য। ফলে বাংলার বাহিনী ব্যাপক দুর্বল হয়ে পড়ে। যুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত জেনে কালাপাহাড় নিজে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করেন ও সুলতান দাউদ শাহ কে পালানোর জন্য তাগাদা দিতে থাকেন। বীরদর্পে আগ্রাসী দখলদার হিন্দুস্তানী ফৌজের বিরুদ্ধে লড়াই করেন দাউদ শাহ।
আবুল ফজলের ভাষায়-
[ সেই উগ্র সিংহ প্রবল বিক্রমে অনেককেই আহত ও নিহত করলেন। যদি তিনি কোনো অশ্বারোহীকে আঘাত করছিলেন, তাহলে ঘোড়াসহ সেই অশ্বারোহীকে তিনি দ্বি-খণ্ডিত করছিলেন। যখনই তিনি কাউকে আঘাত করছিলেন তার মাথা তার পায়ের কাছে পড়ছিলো ]
শেষে দাউদ শাহ পালাতে সম্মত হন। কিন্তু, প্রচণ্ড যুদ্ধে সুলতানের ঘোড়াও নিহত হয়েছিলো। তখন দাউদ শাহর এক চাকর দালিত বাদাখনী সুলতানকে নিজের ঘোড়া প্রদান করলো ও জঘন্য বিশ্বাসঘাতকতা করে সুলতান কোন পথে যাচ্ছেন তা মুঘলদের জানিয়ে দিলো। সুলতান বেশিদূর যেতে পারলেন না। একটি পার্বত্য নদীর কাছেই ধৃত হলেন সুলতান। তাঁকে হাজির করা হলো খান জাহানের সামনে।
খান জাহান হোসেন কুলী খান তুর্কমানের প্রতি আকবরের নির্দেশ ছিলো দাউদ শাহ যদি আকবরের বশ্যতা স্বীকার করে নেন, তাহলে তিনি বাংলার সুবাদার হিসেবে নিযুক্ত হবেন।
দাউদ শাহকে খান জাহান বললেন- বাদশাহ আকবরের বশ্যতা স্বীকার করে নিন।
কিন্তু বাংলার সার্বভৌম সম্রাট যিনি, তিনি কি আর হিন্দুস্তানের অধীনতা মানতে পারেন!
দাউদ শাহ উদ্ধতস্বরে জবাব দিলেন- "বাংলার বাদশাহ আসমানের বাদশাহ ব্যতীত অন্য কারো সামনে মাথা নত করে না।"
দাউদ শাহের মাথা তীক্ষ্ণ তলোয়ার দিয়ে কেটে ফেলা হলো। দাউদের রক্তে বাংলার মাটি লাল হয়ে গেলো। বাঙ্গালার সার্বভৌমত্ব লুপ্ত হলো।
বাংলা সালতানাতের পতনের পর বাংলা নামেমাত্র মুঘল সাম্রাজ্যের প্রদেশে পরিণত হয়, ছড়িয়ে পড়ে বিদ্রোহ। উড়িষ্যায় গাদ্দার কুতলু খানকে রাজত্ব দেয়া হয়,সুন্দরবনে গাদ্দার শ্রীহরি ও তার ভাই বসন্ত রায়কে রাজত্ব দেয়া হয়। বেশিরভাগ অংশ স্বাধীন হয়ে যায়। ভাটির রাজা ঈসা খাঁ বিদ্রোহের লাল ঝান্ডা উত্তোলন করেন। সকল ভূস্বামী ও আফগান দলপতিরা ঈসা খাঁর অধীনে যোগ দিতে থাকেন।
আকবর দ্বীন-ই-ইলাহি প্রবর্তন করে সরাসরি মুর্তাদ হয়ে গেলে আকবরের অনেক সেনানায়ক বিদ্রোহ করেন এবং ভাটিরাজ ঈসা খাঁর কাছে আশ্রয় নেন।
মাসুম খান কাবুলির সাথে আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে যোগদান করেন কালাপাহাড়। আজীবন হিন্দুস্তানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন কালাপাহাড়।
১৫৮৩ সালের ৪ এপ্রিল বিহারে মুঘল বাহিনীর সাথে যুদ্ধে শহিদ হন কালাপাহাড় (রহঃ)
বাংলা থেকে ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তিকে সমূলে উৎখাত করার জন্য সারাজীবন লড়ে গেছেন কালাপাহাড় (রহঃ), মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে দিল্লীর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন বাঙলার স্বাধীনতার জন্য।
২০০৬ সালে উগ্রবাদী হিন্দুরা বিহারে কালাপাহাড় ও তাঁর সহযোদ্ধাদের সমাধি ধ্বংস করে দেয়।
লেখক:- রাজিত তাহমীদ জিত
০৯.০৮.২০২২
তথ্যসূত্র- (১) উড়িষ্যা-কামরূপ বিজয়ী বাঙালি বীর 'কালাপাহাড়' - সরদার আব্দুর রহমান
(২) তারিখ-ই-সালাতিন-ই আফগানা /তারিখ-ই-শাহী - আহমেদ ইয়াদগার
(৩) তারিখ-ই-দাউদী- আব্দুল্লাহ
(৪) তারিখ-ই-বাঙ্গালাহ- মুফতি সলিমউল্লাহ
Read MoreAuthor: Rajit Tahmid Jeet
Historical General 09-August-2022 by east is risingঅনেকে প্রায়ই প্রশ্ন করে থাকেন যে বাংলার সুলতানরা বায়োলজিক্যালি কোন জাতির ছিলেন? আবার অনেকের মধ্যে বদ্ধমূল একটি বড়ো রকমের ভ্রান্ত ধারণা আছে যে, বাঙ্গালা সালতানাতের সুলতানরা নাকি তুর্কী ছিলেন!
আজ সে বিষয় নিয়েই খোলাখুলিভাবে আলোচনা করতে চলেছি। এর উত্তর হলো- স্বাধীন বাংলা সালতানাতে রাজত্বকারী কোনো রাজবংশই তুর্কী ছিলো না, বাংলার একজন সুলতানও তুর্কী ছিলেন না, একজনও নয়।
মহান বাঙ্গালা সালতানাতে (১৩৫২-১৫৩৯, ১৫৫৪-১৫৭৬) ৬ টি রাজবংশ রাজত্ব করেছে। যথা- (১) ইলিয়াস শাহী বংশ, (২) রাজা গণেশের পরিবার বা কানস শাহী বংশ, (৩) হাবশী বংশ (৪) হোসেন শাহী বংশ, (৫) মুহাম্মাদ শাহী বংশ এবং (৬) কররানী রাজবংশ `|| ~
(১) এর মধ্যে বাংলা সালতানাতের সূচনাকারী ইলিয়াস শাহী রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ্ ছিলেন একজন পার্শিয়ান, আরও নির্দিষ্ট করে বললে তিনি ছিলেন সিস্তানী। সিস্তানীরা হলো ইরানে বসবাসকারী একটি স্বতন্ত্র সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী, ইরানের সিস্তান-বালুচিস্তান প্রদেশে যাদের বাস।
সিস্তানীরা ইউরেশিয়ার শক জাতির বংশধর, সিস্তানীরা সুপ্রাচীনকাল থেকে ছিলো যোদ্ধা জাতি।
সুলতান ইলিয়াস শাহ্ ছিলেন একজন পার্শিয়ান ( সিস্তানী) বংশোদ্ভুত ব্যক্তিত্ব এবং তাঁর মাতৃভাষা ছিলো পার্শিয়ান সিস্তানী (ফার্সী ভাষার সিস্তানি উপভাষা)
সুতরাং যেহেতু সুলতান ইলিয়াস শাহ পার্শিয়ান ছিলেন, তাই তার প্রতিষ্ঠিত ইলিয়াস শাহী বংশ এথনিক্যালি পার্শিয়ান (সিস্তানি)
আর ইলিয়াস শাহী বংশের সুলতানরা সকলেই ধর্মান্তরিত বাঙালি নেটিভ বিয়ে করতেন। ইলিয়াস শাহর স্ত্রী সুলতানা ফুলওয়ারা বেগম (ফুলমতী বেগম) ছিলেন বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনীর ব্রাহ্মণ ঘরের মেয়ে, ইসলাম গ্রহণের আগে তাঁর নাম ছিলো- পুষ্পবতী ভট্টাচার্য। তিনি সুলতান সিকান্দার শাহর আম্মা এবং ইলিয়াস শাহর সংগ্রামময় ও সাফল্যমণ্ডিত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের অংশীদার।
ইলিয়াস শাহের সম্রাজ্ঞী সুলতানা ফুলওয়ারা বেগম থেকে শুরু করে সকল ইলিয়াস শাহী সম্রাজ্ঞীই ছিলেন বাঙ্গালী নেটিভ। ইলিয়াস শাহী বংশের রীতি ছিলো নেটিভ বিয়ে করা। ২য় সুলতান সিকান্দার শাহ থেকে আরম্ভ করে জালালউদ্দিন ফতেহ শাহ অবধি ইলিয়াস শাহর সব বংশধর ছিলেন বাঙ্গালী নেটিভ মায়ের সন্তান। আর যেহেতু তারা নেটিভ বাঙালি মায়ের সন্তান, তাই তাদের মাতৃভাষা (মায়ের ভাষা) অবশ্যই বাংলা!
ইলিয়াস শাহ এক অসাধারণ রীতির প্রচলন করেন। ইলিয়াস শাহী সুলতানেরা সবাই বাঙালি বিয়ে করতেন। রাজপরিবারের সদস্যরা নেটিভ বিয়ে করায় রাজপরিবারের দেখাদেখি বহিরাগত অভিজাত মুসলিম আমির-ওমরাহ, সমরনায়ক, সৈনিক ও মন্ত্রীগণও বাঙালি বিয়ে করা শুরু করেন ও বাংলায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ফলে দলে দলে বাংলার অজস্র মানুষ ইসলামের সাম্যের বাণী গ্রহণ করে মুসলিম হতে থাকে। আর এভাবেই বাংলায় ইসলামের ব্যাপক বিস্তার ঘটে এবং, বহিরাগত মুসলিমরা ধীরে ধীরে বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তার সাথে মিশে একাকার হয়ে যান। এভাবেই বহিরাগত মুসলিমরা বাংলা জনজাতির সাথে মিশে যাওয়া শুরু করেন, তারা পরিণত হন বাঙ্গালীতে।
তাই যেহেতু সিকান্দার শাহ থেকে শুরু করে সব সুলতানের মা-ই ছিলেন নেটিভ বাঙালি, তাই ইলিয়াস শাহী বংশ ছিলো- "সিস্তানী ও বাঙালির মিশ্রিত ধারা"
(২) রাজা গণেশের পরিবার বা কানস শাহী বংশ বায়োলজিক্যালি নেটিভ বাঙালিই ছিলো- সবারই জানা।
গণেশের পুত্র সুলতান জালালউদ্দিন মুহাম্মাদ শাহর রাজত্বকালে বাংলায় সবচেয়ে বেশি ইসলামের বিস্তার ঘটেছিলো। এটি প্রায় সবারই জানা যে, রাজা গণেশের পরিবার জাতিগতভাবে বাঙ্গালিই। গণেশ ছিলো বারেন্দ্রী ব্রাহ্মণ, দিনাজপুরের জমিদার। সে ইলিয়াস শাহী সুলতানদের দুর্বলতার সুযোগে ক্ষমতার দখল নিয়ে মুসলিমদের উপর অত্যাচার করা শুরু করে দিয়েছিলো। আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজকুমার যদু ইসলাম গ্রহণ করেন ও পিতা ও ছোটভাইকে হত্যা করে ইসলামি সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।
(৩) হাবশীরা ছিলো আবিসিনিয়ান বা ইথিওপিয়ান। তাদেরকে বারবাক শাহর আমলে পঙ্গপালের মত নিয়ে আসা হয়েছিলো সেনাবাহিনী, প্রশাসনে নিযুক্তির জন্য। এরা একসময় ইলিয়াস শাহী বংশকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে নেয় ও ছয় বছর চরম দুঃশাসন চালায়।
উল্লেখ্য, হাবশিদের সাথে বাঙালির কোনো মিশ্রণ ঘটেনি। কারণ, হাবশি দাসদের পাশাপাশি অনেক হাবশী দাসীকেও আনা হয়েছিলো। ক্রীতদাসদের সাথে ঐ আবিসিনিয় দাসীদের-ই বৈবাহিক সম্পর্ক হয়েছিলো। কোনো বাঙালিকে তারা বিবাহ করেনি কখনো এবং হাবশিদের উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করার পর সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্ তাদেরকে বাংলা থেকে চিরতরে বহিষ্কার করেছিলেন।
(৪) হোসেন শাহী বংশ এথনিক্যালি বাঙালি নেটিভই ছিলো।
বুকাননের মতে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ছিলেন পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার সন্তান।
যৌবনে গৌড়ের আধিকারিক সুবুদ্ধি রায়ের কর্মচারী ছিলেন তিনি।
অনেক ক্ষেত্রে উল্লেখ করা হয় যে, আলাউদ্দিন হোসেন শাহ আরব ছিলেন। ধারণা করার কারণ তাঁর নামের পূর্বে 'সৈয়দ' (সৈয়দ হোসেন) তাই বলা হয়ে থাকে অনেকক্ষেত্রে যে, তিনি নাকি মক্কার শরিফের সন্তান - রাসুল (সা.) এর বংশধর। রাসুল (সা.) এর বংশধরের নামের পূর্বে সৈয়দ/সায়্যিদ ব্যবহারের রীতি এসেছে শিয়াদের থেকে।
কিন্তু হোসেন শাহ ছিলেন সুন্নি। তাই রমেশ্চন্দ্র সাহার এই "সৈয়দ তত্ত্ব' গ্রহণযোগ্য নয়। আরবিতে সৈয়দ অর্থ জনাব, হোসেন শাহ উত্তরবঙ্গের নেটিভ সৈয়দ পরিবারের ছিলেন।
এছাড়া তিনি গৌড়ের সুবুদ্ধি রায়ের অধীনে কাজ করেছেন যৌবনে। একজন শরিফের সন্তান বাংলায় এসে নিম্নপদে তাও অমুসলিমের অধীনে কাজ করবেন- এটি অনেকটাই ভ্রান্ত ধারণা।
হোসেন শাহ তাঁর উস্তাদ চাঁদ কাজীর কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন বলে শক্ত মত রয়েছে।
এই সকল কিছু
বিবেচনায় প্রমাণিত হয় যে, তিনি নেটিভ বাঙালি ছিলেন, হোসেন শাহী রাজবংশ নেটিভ। এছাড়া হোসেন শাহী বংশও ইলিয়াস শাহী বংশের মতোই বংশানুক্রমে বাঙালি নেটিভই বিবাহ করতেন। তাঁর প্রমাণ হিসেবে অনেক পুঁথিতে গ্রাম সম্পর্কে চৈতন্যকে হোসেন শাহর শ্যালক বলা হয়েছে।
হোসেন শাহ নিজে নেটিভ বিবাহ করেছিলেন। তাঁর সম্রাজ্ঞী নেটিভ ছিলেন...এছাড়া নুসরত শাহ নেটিভ ছাড়াও দিল্লীর সুলতান ইব্রাহিম লোদীর কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন।
(৫) মুহাম্মাদ শাহী ও কররানী বংশ দুইটাই পাঠান। মুহাম্মাদ শাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মাদ খান শূর ও কররানী বংশের প্রতিষ্ঠাতা তাজ খান কররানী।
দাউদ শাহ কররানীর পতনের পর তাঁর পুত্র শাহজাদা হাসান ও পরিবারবর্গ সিলেটে আশ্রয় গ্রহণ করেন। শাহজাদা হাসানের পুত্র দ্বিতীয় বায়েজিদ কররানী সিলেটের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে ভাটিরাজ ঈসা খাঁর অধীনে মুগল প্রতিহতকরণে যোগ দেন। পরবর্তীতে বারো ভূঁইয়াদের পতনের পরও বাংলায় আসা আফগানরা বাংলাতেই স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করেন এবং নেটিভ বিবাহ করে বাস করতে করতে বাংলার সাথে মিশে যান।
সুতরাং, দেখা যাচ্ছে বাংলা সালতানাতের কোনো সুলতানই তুর্কী ছিলেন না, একজনও না। ইলিয়াস শাহী বংশ সিস্তানি ও বাঙালির মিশ্রিত ধারা, গণেশের পরিবার বাঙালি, হোসেন শাহী বংশ বাঙালি, এবং মুহাম্মাদ শাহী ও কররানী বংশ পাঠান।
তাই যারা বলে থাকেন বাংলা সালতানাত তুর্কীদের শাসন, কথাটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত।
তাহলে তুর্কী কারা ছিলেন? তুর্কী ছিলেন বখতিয়ার খলজী ও গৌড়ে নিযুক্ত দিল্লীর সুলতানের গভর্নররা। তারা কোনো সুলতান ছিলেন না, বখতিয়ার খলজি ও খলজিরা কোনো সুলতান ছিলেন না,তিনি ছিলেন কুতুব উদ্দিন আইবেকের গভর্নর। দিল্লী সালতানাতের অধীনস্থ বাংলার গভর্নররা ও লখনৌতির বলবানী শাসকেরা ছিলেন তুর্কী (১২০৪-১৩৩৮) ,, তারা বাংলা সালতানাতের কেউ ছিলো না।
বাংলা সালতানাত প্রতিষ্ঠার পূর্ববর্তী বাংলার শাসকেরা ছিলেন তুর্কী, তখন বাংলা সালতানাত ছিল না,, ছিল দিল্লীর প্রদেশ ( ১২০৪-১২৮৭, ১৩২২-১৩৩৮) এবং বলবানী সুলতানদের শাসন (১২৮৭-১৩২২)
বাংলা সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হয় ১৩৫২ সালে ইলইয়াস শাহ কর্তৃক পুরো বাংলা জয়ের মাধ্যমে।
বাঙ্গালা সাম্রাজ্যের সুলতানরা কেউই তুর্কী ছিলেন না, ছিলেন পার্শিয়ান, বাঙালি ও পাঠান এবং তারা এথনিক্যালি যাই হয়ে থাকেন না কেন, বাঙালি জনজাতির সাথে মিশে তারা বাঙালিতে পরিণত হয়ে গিয়েছিলেন কালক্রমে। আর জেনে রাখা ভালো-
ইলিয়াস শাহ থেকে শুরু করে বাংলার সুলতানেরা সবাই নিজেকে পরিচয় দিতেন "বাঙ্গালী" নামে। শুধু সুলতানেরাই নয়, বাংলা সালতানাতের সব অভিজাত ও কর্মকর্তারাই নিজেদের পরিচয় দিতেন "বাঙ্গালি" নামে, সে তারা আরব, তুর্কি,পাঠান, বালুচ, ইরানি, তাজিক যাই হয়ে থাকুক না কেনো- বহির্বিশ্বে তাঁরা নিজেদের পরিচয় দিতেন 'বাঙ্গালী' নামে। ইরানি বংশোদ্ভুত ইলিয়াস শাহ্ নিজেকে পরিচয় দিয়েছিলেন "শাহ-ই-বাঙ্গালিয়ান" (বাঙালির সম্রাট) নামে। যিনি বাংলার তিনিই বাঙালি- তিনি এথনিক্যালি আরব না তুর্কি না অন্যকিছু সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। তিনি আরব বা তিনি পাঠান, বাংলার অধিবাসী যিনি তার নাগরিক পরিচয় তিনি বাঙ্গালী। আর এভাবেই শুরু হয় বাংলার মানুষের জাতিগত স্বতন্ত্র পরিচয় বা বাঙ্গালি পরিচয়ের।
বাংলার সুলতানেরা নিজেকে পরিচয় দিতেন "শাহ-ই-বাঙ্গালিয়ান" নামে এবং বাংলা সালতানাতের সৈন্যরা দিল্লীসহ সারাবিশ্বে পরিচিত হয় "পাইক-ই-বাঙ্গালাহ" হিসেবে। বাঙালি নামে যে আলাদা একটা রাজনৈতিক শক্তি আছে, তা ১৩৫২ সালের আগে ছিলোইনা, বাঙ্গালী জাতিপরিচয়ের স্রষ্টা সুলতান ইলিয়াস শাহ গাজী (রহঃ)
শায়খ নূর কুতুব উল আলম ছিলেন শাহী বাংলা সাম্রাজ্যের প্রধান ইসলামিক স্কলার। বিশ্বে তিনি পরিচিত ছিলেন "শেখ নূর বাঙ্গালী" নামে [যদিও তিনি ছিলেন এথনিক্যালি আরব]
বাংলা নামে যে আলদা কোনো জাতি আছে তার স্রষ্টাই হয়েছে বাংলা সালতানাতের মাধ্যমে। তার আগে পৃথিবী বাংলাকে জাতিপরিচয়ের ভিত্তিতে চিনতোইনা। উল্লেখ্য, এর আগে কখনো এই অঞ্চলের মানুষ নিজেদের বাঙালি পরিচয় দিতেন না, না দিতেন পরাক্রমশালী সুশাসক পাল সম্রাটেরা, না দিত দক্ষিণ ভারত থেকে আগত দ-খ-ল-দা-র শত শত শূদ্র ও বৌদ্ধের হত্যাকারী সেনরাজারা, না দিতো ধর্মান্ধ শশাঙ্ক,না দিতো দিল্লীর তুর্কি গভর্নররা (১২০৪-১৩৩৮)
মুঘল আমলে বাংলার সুবাদার ও অভিজাতরা নিজেদের হিন্দুস্তানী বলে দিতেন- বাঙ্গালি নামে তারাও পরিচয় দিতেন না নিজেকে। মুঘল বাদশাহ ও অফিসাররাও নিজেদের পরিচয় দিতেন হিন্দুস্তানী নামে। এভাবে 'হিন্দুস্তানী' পরিচয় নির্মাণে যেমন মুঘলরা ভূমিকা রেখেছিলো,
তেমনি বাঙ্গালি পরিচয় নির্মাণে ভূমিকা রেখেছিলেন কেবলমাত্র শাহী বাঙ্গালার সুলতানেরা।
বাংলা সালতানাত তাই বিশ্বে পরিচিত হয় বাঙ্গালি সাম্রাজ্য নামে এবং বাংলার সুলতানকে সারাবিশ্ব চিনতো বাঙালির সুলতান নামে, বাঙালির বাদশাহ নামে, সে তিনি হোক নেটিভ বা হোক ইরানি বা হোক পাঠান..
They were Bengali not because they were born in Bengal but because Bengal was born in them...
এই বাংলাভূমিকে তাঁরাই করেছিলেন পরাশক্তি - করেছিলেন "দারুল ইসলাম", তাই আজ সারা ভারত হিন্দু অধ্যুষিত হয়েও আমাদের বাংলা আজ মুসলিম অধ্যুষিত। আলহামদুলিল্লাহ!
উৎস:
১) তারিখ-ই-মুবারাক শাহী
২) তারিখ-ই-দাউদি
৩) আইন-ই-আকবরী
৪) রিয়ায উস সালাতিন
৫) তারিখ-ই-ফিরিশতা
৬) "ভারতজনের ইতিহাস" - শ্রীবিনয় ঘোষ
৭) চৈতন্যপুরাণ
৮) মধ্যযুগে বাংলার শাসক- আসকার ইবনে শাইখ
----------------------®-------------------------------------------
Read MoreAuthor: Rajit Tahmid Jeet
Historical General 06-August-2022 by east is risingএই তোপ এতোটাই শক্তিশালী ছিলো যে কাছাকাছি কোন গর্ভবতী নারী থাকলে এই তোপের বিকট আওয়াজে ডেলিভারি হয়ে যেতো! তাই এই তোপের নাম "তোপ-ই-বাচ্চাওয়ালী"।
৭,৭৭৯ সের ওজনের এই তোপ টেনে নিয়ে যেতো ৫০০ মহিষ।
সুলতান ইলিয়াস শাহ ১৩৪৮ সালে উড়িষ্যার পূর্বগঙ্গ রাজবংশের সম্রাট ত্রিকলিঙ্গেশ্বর (উৎকল, মহাশোল ও কলিঙ্গ) তৃতীয় নরসিংহদেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাচ্চাওয়ালী তোপ ব্যবহার করেন। ১৩৪৮ সালে উড়িষ্যা জয় করেন ইলিয়াস শাহ্।
এই বিরাট তোপটিই ছিলো ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম ও এশিয়ার দ্বিতীয় তোপ। চীনের পর ইলিয়াস শাহ-ই প্রথম তোপ ব্যবহার করেন।
উল্লেখ্য, সম্রাট বাবর ১৫২৬ সালের ২১শে এপ্রিল পানিপথের যুদ্ধে প্রথম আধুনিক তোপ ব্যবহার করেছিলেন, কামান আরও আগে থেকেই ব্যবহৃত হয়ে এসেছিলো,, তবে ভারতে প্রথম "আধুনিক কামান" ব্যবহার করেন জহিরুদ্দীন মুহাম্মদ বাবর। আধুনিক তোপ ব্যবহারের কৃতিত্ব বাবরের হলেও উপমহাদেশের প্রথম তোপ, এশিয়ার ২য় তোপ ও বিশ্বে তৃতীয় তোপ ব্যবহারের কৃতিত্ব সুলতান ইলিয়াস শাহের ||
সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ্ ১৩৪৮ সালে নরসিংহদেবকে পরাজিত করে উড়িষ্যা জয় করেন। উড়িষ্যার বিশাল হস্তী বাহিনী ও অগ্নিবাণ নিক্ষেপকারী সৈনিকদের রক্তে চিল্কা হ্রদের পানি লাল হয়ে যায়।
ইলিয়াস শাহ্ পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে তোপ দেগে পুরো মন্দির ধুলিসাৎ করে দেন। মন্দির ধুলিসাৎ হয়ে মাটির সাথে মিশে যায় ; মন্দির ধুলিসাৎ হয়ে গেলেও জগন্নাথ দেবের কোনো খোঁজ অবশ্য মেলে নি!
নরসিংহদেব যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করেন। উড়িষ্যা জয় করে ইলইয়াস শাহ "গাজী" উপাধি ধারণ করেন।
উড়িষ্যা আক্রমণে তোপ ব্যবহারের প্রথম প্রমাণ পাওয়া যায়- "বিশাখাপত্তনম্" (বিশাখাপত্তনম, অন্ধ্রপ্রদেশ, ভারত ) শাসনকারী কন-রাজবংশের ২য় কেদারের উৎসর্গকৃত সংস্কৃত শ্লোক থেকে। উল্লেখ্য যে, কনরাজ ছিলেন সুলতান ইল্ইয়াস শাহ্'র তাবেদার শাসক।
তোপটি বর্তমানে মুর্শিদাবাদে হাজার দুয়ারী প্যালেস মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে।।
Author: Rajit Tahmid Jeet
Historical General 05-August-2022 by east is rising