যদিহাস্তি তদন্যত্র, যন্নেহাস্তি ন তৎ ক্বচিৎ’। (‘মহাভারত’, ১/৫৬/৩৩)
অর্থাৎ যা ‘মহাভারত’-এ আছে তা ভারতে আছে, আর যা ‘মহাভারত’-এ নেই তা ভারতেও নেই। এই একটি উ‘ক্তিই ভারতভূমির সাথে গ্রন্থটির নিবিড় ও অকৃত্রিম আত্মীয়তাকে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট করে। বিষয়ের গুরুত্বে ও আয়তনে মহান ‘মহাভারত’ ভারতবর্ষের পৌরাণিক চিন্তাধারার এক উজ্জ্বল দলিল। একে ‘কাব্য’,‘মহাকাব্য’,‘ইতিহাস’, ‘আখ্যান’, ‘উপাখ্যান’, ‘ধর্মশাস্ত্র’, ‘মোক্ষশাস্ত্র’ ইত্যাদি যাই বলা হোক না কেন, গ্রন্থটি আসলে আমাদের পূর্বপুরুষদের চিন্তাধারা ও মানসিকতাকে ব্যক্ত করছে। যেকোনো সাহিত্যগত উপাদানের একটি অন্যতম উদ্দেশ্যই বোধ করি তাই। আসলে সাহিত্যিক উপাদানগুলি বিভিন্ন চরিত্র ও ঘটনার মাধ্যমে সমসাময়িক সমাজ ও সামাজিক মানসিকতাকে পরোক্ষে লিপিবদ্ধ করে রাখে। সময়ে সময়ে গবেষকগণ সেই সূত্র ধরে নতুন নতুন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে ইতিহাসকে আরও পুষ্ট করেন। ‘মহাভারত’-ও তেমনই এক মূল্যবান উপাদান যা বহু বিচিত্র তথ্য তালাশের জাদুকাঠি।
আলোচনার শুরুতে ‘মহাভারত’ গ্রন্থটি সম্পর্কে প্রাথমিক একটা ধারণা করে নেওয়া প্রয়োজন। লোকবিশ্বাস অনুসারে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস এই সুবৃহৎ গ্রন্থের রচয়িতা এবং বর্ণিত কাহিনির একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তবে ১৮টি পর্ব ও লক্ষাধিক শ্লোকসমন্বিত যে ‘মহাভারত’ বর্তমানে প্রচলিত আছে তার মূল শ্লোকসংখ্যা বিষয়ে মতান্তর আছে। কখনও একে ‘অষ্টৌ শ্লোকশতানি অষ্টৌ শ্লোকসহস্রাণি’ অর্থাৎ ৮,৮০০ শ্লোকের বলা হয়েছে। কখনও ‘চতুর্বিংশতিসাহস্রী সংহিতা’ অর্থাৎ ২৪,০০০ শ্লোকসমন্বিত বলা হয়েছে। আবার কখনও মহাভারতের শ্লোকসংখ্যা ‘শতসাহস্রী সংহিতা’ অর্থাৎ ১,০০০০০। এই তথ্যের ভিত্তিতে বহু গবেষক মহাভারত রচনাক্রমকে তিনটি স্তরে ভাগ করেছেন। আবার ‘আদি পর্ব’-এর সাক্ষ্য অনুসারে ‘মহাভারত’-এর কাহিনি তিন বার তিন জন পৃথক ব্যক্তির দ্বারা বিবৃত হয়েছে। তাহলে সম্পূর্ণ বিষয়টিকে সহজ করে সাজিয়ে নিয়ে বলতে পারি—
১) প্রথম স্তরঃ শ্লোকসংখ্যা ৮,৮০০। বক্তা ব্যাস আর শ্রোতা ব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন। এটি ‘জয়’ নামে খ্যাত।
২) দ্বিতীয় স্তরঃ শ্লোকসংখ্যা ২৪,০০০। বক্তা বৈশম্পায়ন, শ্রোতা জনমেজয়। ‘ভারত’ নামে খ্যাত।
৩) তৃতীয় স্তরঃ শ্লোকসংখ্যা ১,০০০০০। বক্তা সৌতি, শ্রোতা শৌনকাদি ঋষিগণ। এটিই আসলে লোকবিশ্রুত ‘মহাভারত’।
প্রবন্ধের মূল বিষয়ের আলোচনার স্বার্থে ‘মহাভারত’-এর রচনাকাল সম্পর্কে ধারণা আবশ্যক। প্রাচীন ভারতের যেকোনো ব্যক্তি বা দলিলের কালনির্ণয় কঠিনতম অংশ। তথ্যের অভাবে তুলনাত্মক জটিল অঙ্কের সিঁড়ি বেয়ে আনুমানিক সময়ে পৌঁছোতে হয়। ‘মহাভারত’-ও ব্যতিক্রম নয়। আশ্বলায়নের ‘গৃহ্যসূত্র’ সম্ভবত প্রাচীনতম দলিল যেখানে ‘মহাভারত’-এর উল্লেখ পাই এবং এর সময় আনুমানিক ৫ম খ্রিস্টপূর্বাব্দ। অপরদিকে ৪৪৫ খ্রিস্টাব্দের গুপ্তযুগীয় অভিলেখ সম্ভবত প্রথম দলিল যাতে লক্ষশ্লোকযুক্ত ‘মহাভারত’-এর উল্লেখ রয়েছে। অধিক জটিল আলোচনায় প্রবেশ না করে বলতে পারি, ৫ম খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত একটি সুদীর্ঘ সময় ধরে এই কালজয়ী গ্রন্থ একটু একটু করে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন সময়ের বহু কবিপ্রতিভার স্পর্শে ধন্য ‘মহাভারত’ নামক সিন্ধুর বুকে লুক্কায়িত রয়েছে মূল্যবান বহু অপ্রিয় সত্য।
ভারতে ‘মহাভারত’-এর একাধিক সংস্করণ প্রচলিত আছে। তাদের পর্ব ও শ্লোকসংখ্যা বিভিন্ন। আবার বাংলা ভাষার বিখ্যাত সংস্করণগুলির মধ্যেও পাঠান্তর ও ব্যতিক্রম প্রচুর। শুধু তাই নয়, সংস্করণগুলির মধ্যে পর্বাধ্যায়সংখ্যা, তাদের বিন্যাস বা শ্লোক সংখ্যাগত পার্থক্যও অনেক। এই সকল পাঠান্তর ও ব্যত্যয় গবেষণার বিভিন্ন শাখার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু এসব জটিলতা আলোচ্য বিষয়ের জন্য জরুরি নয়। অত্যন্ত পরিচিত ও প্রচলিত কাহিনিনির্ভর এই আলোচনা।
এইবার আসা যাক প্রবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয়ে অর্থাৎ ‘ব্রাহ্মণ’ দ্রোণাচার্য চরিত্রের বিশ্লেষণে। দ্রোণের অন্যান্য পরিচয় ছেড়ে সচেতনভাবে তাঁকে ‘ব্রাহ্মণ’ বিশেষণে বিশেষায়িত করা কেন? কারণ দ্রোণ চরিত্রের যত বিড়ম্বনা ঠিক ওখান থেকেই শুরু হয়। কীভাবে? তা ক্রমশ প্রকাশ্য। ঋষি ভরদ্বাজের পুত্র দ্রোণ প্রথমে পিতার কাছে অস্ত্র শিক্ষা করেন।তারপর মহর্ষি অগ্নিবেশ্যের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র শিক্ষায় পারদর্শী হন। পিতার আদেশে কৃপাচার্যের ভগিনী কৃপীকে বিবাহ করেন। অশ্বত্থামা নামে তাঁদের এক অতি তেজস্বী পুত্র সন্তান জন্মায়।পিতার মৃত্যুর পর দ্রোণ শ্রেষ্ঠ অস্ত্রজ্ঞ পরশুরামের কাছে বহু বিচিত্র ও অসাধারণ অস্ত্রের প্রয়োগ ও প্রত্যাহার শিক্ষা করে হয়ে উঠলেন অন্যতম যুগশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা।এই পর্যন্ত দ্রোণের জীবন নিয়ে কারও কোন প্রশ্ন ছিলনা। প্রশ্ন থাকার কথাও নয়। কারণ এক সাধারণ ব্রাহ্মণ সন্তান আর পাঁচটা সাধারণ ব্রাহ্মণ পরিবারের মতোই জীবন অতিবাহিত করছেন।পিতার নির্দেশে অল্পকেশী সাধারণ কন্যাকে বিয়ে, সন্তান। আর ব্রাহ্মণের যা কাজ, মানে এই গুরু ওই গুরুর কাছে নতুন নতুন শিক্ষা গ্রহণ করে বেড়ানো।কিন্তু দ্রোণ তো অস্ত্রশিক্ষা করছিলেন? তাতে কী! তিনি তো শিখছিলেন, তার প্রয়োগ তো করেননি। তাই এই পর্যন্ত সব ঠিক ছিল।বিড়ম্বনা শুরু হল দ্রোণ যখন দ্রোণাচার্য হলেন অর্থাৎ রাজার বেতন ভোগী অস্ত্রবিদ্যার শিক্ষক হলেন। ব্রাহ্মণ হয়ে অস্ত্রজীবী! সমালোচনা ক্রমশ অসম হতে লাগল। বনে-জঙ্গলে যৎসামান্য ছাউনির তলায় বসে, ক্ষুধাকে অস্বীকার করে, ইহলোক ও পরলোকের গূঢ়তত্ত্ব চর্বিত চর্বণ না করে এই ব্রাহ্মণ কী না রাজগৃহে থেকে, ভালো ভোজন করে, রাজপুত্রদের অস্ত্রশিক্ষা দেওয়ার সাহস দেখায়! অনিবার্য সমালোচনা; ব্রাহ্মণ মানেই ক্ষমতালোভী ও সুযোগ সন্ধানী। একলব্যের প্রসঙ্গ এলে তো আর কথাই নেই। সকলে সমস্বরে দ্রোণাচার্যের মুণ্ডচ্ছেদনে ব্রতী হন। এত নিষ্ঠুরতা ও জাতিবিদ্বেষ ব্রাহ্মণ ছাড়া আর কোনো প্রাণীর মধ্যেই নেই। দ্রোণাচার্য গুরুকুলের কলঙ্ক— এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে কেউ বিন্দুমাত্র সময় ব্যয় করেন না। তাছাড়া অন্যায় যুদ্ধে দ্রোণাচার্যের সেনাপতিত্বে যেভাবে নির্বিচারে অভিমন্যুকে হত্যা করা হয়েছে তাতে দ্রোণাচার্য চরিত্রের নির্মম পাশবিকরূপ স্পষ্ট। এইরকম শত শত অভিযোগ ও সমালোচনার শরে দ্রোণাচার্য আহত ও পীড়িত। নিঃসন্দেহে কিছু ঘটনার আকস্মিকতা হৃদয়কে সহস্রছিন্ন করে। কিন্তু সমালোচনা তো ভালো-মন্দ, আলো-অন্ধকার, কোমলতা-কাঠিন্য উভয়ের সামঞ্জস্যতার অপেক্ষা রাখে। চরম নিষ্ঠুরতার মধ্যে কোনো পরম প্রিয়ের আঘাত বীজ হিসেবে লুকিয়ে রয়েছে কি না তার অনুসন্ধানই বিশ্লেষণকে নিটোল করে। প্রবন্ধটি এইধরনের কিছু প্রবণতা অন্বেষণের একটি প্রয়াস।
মনে রাখতে হবে, যে সুদীর্ঘ সময়কে আমরা ‘মহাভারত’ সংকলনের সময় হিসেবে নির্দেশ করেছি সেই সময়ের সমাজ ব্যবস্থাপনায় ‘কৌটিলীয়-অর্থশাস্ত্র’ ও ‘মনুস্মৃতি’ এই দুই গ্রন্থের প্রভাব ছিল বিস্তর। এই দুই গ্রন্থের সাক্ষ্য অনুযায়ী সমাজ পরিচালনার ভিত্তি ছিল ‘বর্ণাশ্রম-ব্যবস্থা’। এদের মধ্যে ‘বর্ণ-ব্যবস্থা’-র ওপর বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। চার ‘বর্ণ’ হল—‘ব্রাহ্মণ’, ‘ক্ষত্রিয়’, ‘বৈশ্য’ ও ‘শূদ্র’। এদের কাজও নির্দিষ্ট। ব্রাহ্মণের কাজ— অধ্যয়ন, অধ্যাপনা, যজন, যাজন, দান ও প্রতিগ্রহ। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ হল সমাজের সুশিক্ষিত অংশ। ক্ষত্রিয়ের কাজ— অধ্যয়ন, যজন, দান ও অস্ত্রজীবী হওয়া বা প্রজাপালন করা। সহজ কথায় ক্ষত্রিয়রা হল সমাজের ক্ষমতাবান অংশ। বৈশ্যদের কাজ— অধ্যয়ন, যজন, দান, কৃষি, পশুপালন, বাণিজ্য, ঋণদান। অর্থাৎ বৈশ্যরা হল সমাজের বিত্তবান অংশ। শূদ্রদের কাজ— বাকি তিন বর্ণের সেবা করা। সহজ করে বললে যুদ্ধ, কৃষি, পশুপালন, শিল্প প্রভৃতি ক্ষেত্রে যে বিপুল পেশিশক্তি প্রয়োজন তার যোগান দেয় শূদ্ররা। অর্থাৎ শূদ্ররা হল সমাজের শ্রমজীবী অংশ। এই প্রবন্ধে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রের পরিবর্তে যথাক্রমে শিক্ষিত, ক্ষমতাবান, বিত্তবান ও শ্রমজীবী/পেশিশক্তি শব্দগুলি সচেতনভাবে বার বার ব্যবহৃত হবে। যাইহোক, এই বর্ণ-ব্যবস্থার মধ্যেই পরস্পরকে লড়িয়ে দেওয়ার যথেষ্ট উপাদান ছিল। পাঠকগণ চিন্তা করে দেখুন, ব্রাহ্মণ অর্থাৎ যারা সমাজের সবচেয়ে শিক্ষিত অংশ তাদের সামান্য জীবিকাটুকু নির্দিষ্ট হল না। শিক্ষিতদের হাতে না থাকল উপার্জনের ক্ষমতা, না থাকল প্রশাসনিক ক্ষমতা। অপর দিকে ক্ষত্রিয় অর্থাৎ যাদের হাতে শাসনক্ষমতা তাদের হাতে অর্থকরী ক্ষেত্রগুলির (কৃষি, পশুপালন, শিল্প, বাণিজ্য ইত্যাদি) সরাসরি নিয়ন্ত্রণ বা শিক্ষিতদের মতো সামাজিক খ্যাতি কোনোটাই রইল না। আবার বৈশ্যরা অর্থাৎ যাদের হাতে বিপুল অর্থ তাদের কাছে প্রশাসনকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করবার ক্ষমতাও নেই এবং শিক্ষিতের মতো সামাজিক প্রতিষ্ঠাও নেই। শূদ্ররা অর্থাৎ যাদের পেশির ওপর নির্ভর করে ক্ষমতাবানরা বছরের পর বছর ক্ষমতায় থাকছে, যাদের শ্রম ও দক্ষতার ওপর ভর করে বিত্তবানরা তাদের শিল্প-বাণিজ্যের প্রসার করে আরও বিত্তশালী হচ্ছে তাদের হাতে প্রায় কিছুই নেই। শিক্ষার অধিকার নেই, জমির অধিকার নেই, আর্থিক, সামাজিক বা প্রশাসনিক নিরাপত্তাও নেই। ফলে এই চার বর্ণের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা ছিল খুব স্বাভাবিক। কিন্তু যুগ যুগ ধরে কী সুচারু ও সুচতুর কৌশলে এই প্রতিযোগিতাকে করে তোলা হয়েছে দ্বিপাক্ষিক। তাই লড়াইটা হয়ে উঠল শুধু ব্রাহ্মণ আর শূদ্রের। অথচ এই দুই ‘বর্ণ’-ই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। শাস্ত্রসমূহের ব্যাখ্যা এমনভাবে হতে লাগল যেন ব্রাহ্মণই কেবল শূদ্রকে অস্পৃশ্য মনে করে কিন্তু ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের গৃহে তাদের অবাধ বিচরণ। কিছু আজব নিয়ম-কানুনকে হাতিয়ার করে শিক্ষিত ব্রাহ্মণরা দারিদ্র আর জীবিকাহীনতার হতাশা শূদ্র-অত্যাচারের মাধ্যমে চরিতার্থ করতে লাগল। অপরদিকে, বিত্তবান বা ক্ষমতাবান কোনো প্রভুর অধীনস্ত শূদ্ররা মনিবের অত্যাচার জীবিকার খাতিরে মানতে বাধ্য হলেও হতদরিদ্র, অশৌখিন ব্রাহ্মণদের অযথা লাঞ্ছনা সহ্য করতে বা পারিশ্রমিকহীন সেবা প্রদান করতে ইচ্ছুক ছিল না। অগত্যা নিজেদের সমস্যা ও বঞ্চনার প্রতিকারের পরিবর্তে এই দুই বর্ণের মধ্যে পারস্পরিক বৈরিতা বাড়তে লাগল। সমাজের ক্ষমতাবান বা বিত্তশালীরা এই দ্বন্দ্বের অখণ্ড ফল ভোগ করে গেল।‘বর্ণ-ব্যবস্থা’-য় চার ‘বর্ণ’-এর উল্লেখের ক্রমের মধ্যেও যেন এই ষড়যন্ত্রের আভাস আছে। লক্ষ্য করুন, এই ক্রমে ব্রাহ্মণের সঙ্গে তার পরের পরের ‘বর্ণ’-এর সঙ্গে যোগাযোগ ও হৃদ্যতা ক্রমশ কমছে। ব্রাহ্মণের সাথে (অবশ্যই মুষ্টিমেয় কিছু ব্রাহ্মণ) ক্ষত্রিয়ের যে সম্পর্ক, বৈশ্যের সাথে তা অনেকটাই দুর্বল। আবার বৈশ্যের সাথে ব্রাহ্মণের যে দুর্বল যোগাযোগ তা শূদ্রের কাছে গিয়ে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ কায়দা করে শিক্ষিতদের অর্থবল ও লোকবল থেকে দূরে রাখা হচ্ছে। সমাজের এই সবকটি মানসিকতা ক্ষমতা ও অর্থের অলিন্দে থাকা একটা শ্রেণির গভীর ষড়যন্ত্রের ফসল। আর দ্রোণাচার্য তার একটি শিকার।
দ্রোণের প্রথম অপরাধ তিনি ব্রাহ্মণোচিত বৃত্তির পরিবর্তে ক্ষাত্রধর্মকে বৃত্তি করেছেন। অনিবার্যভাবে দ্রোণাচার্যের সাথে শাস্ত্রঅবমাননাকারী, ক্ষমতালোভী ইত্যাদি বিশেষণ সেঁটে দেওয়া হল। আমি আর একটু তলিয়ে ভাবতে চাই। দ্রোণাচার্য যে শুধু মহান অস্ত্রজ্ঞ ছিলেন তাই নয় বেদ, বেদাঙ্গ, মনুর নীতিশাস্ত্রাদিতেও দ্রোণ নিষ্ণাত। এই ধরনের বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তি যেকোনো দেশের অমূল্য সম্পদ। কিন্তু ভাগ্যের কী নিষ্ঠুর পরিহাস! পূর্বে দ্রোণ ছিলেন পাঞ্চালদেশের অধিবাসী। একদিন তাঁর পুত্র অশ্বত্থামা ধনিপুত্রদের দুধ খেতে দেখে বাবা দ্রোণের কাছে এসে কাঁদতে লাগল। বালককে দুধ খাওয়ানোর আশায় উচ্চশিক্ষিত দ্রোণ ধর্মসঙ্গত উপায়ে পয়স্বিনী গাভী সংগ্রহের চেষ্টা করলেন এবং ব্যর্থ হলেন। দান যদি ব্রাহ্মণের উপার্জনের সাধন হয় তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে দান অপরের ইচ্ছাধীন। যখন যেটা প্রয়োজন তখন সেই বস্তুই লোকে দান করবে এমন কাকতালীয় ঘটনা তো আর বার বার ঘটবে না। ইতিমধ্যে ধনিপুত্ররা শিক্ষিত অথচ উপার্জনহীন ব্রাহ্মণ দ্রোণের পুত্রের সাথে আর একটু তামাশা করল। অশ্বত্থামাকে তারা পিটুলি (চাল বাটা) গোলা জল খেতে দিল। তা খেয়েই দ্রোণের পুত্র আহ্লাদে আটখানা। অর্থাৎ বালক অশ্বত্থামা শিশু বয়সেও কোনোদিন দুধের আস্বাদ পায়নি। সেই কারণে বালক অশ্বত্থামা পিটুলি গোলা জলকেই দুধ বলে পান করে আনন্দ পাচ্ছে। ধিক সেই যোগ্যতাকে যে যোগ্যতায় একজন পিতা তার সন্তানের জন্য একটু দুধ জোটাতে পারে না। ধিক সেই সামাজিক ব্যবস্থাপনাকে যে ব্যবস্থাপনায় দরিদ্রদের সামান্য সামাজিক সম্মান ও অধিকারটুকু নিশ্চিত হয় না। অগাধ যোগ্যতাসম্পন্ন দ্রোণের জীবনে এর থেকে বেশি হতাশাজনক এবং অপমানের আর কী হতে পারে?একদিকে শিক্ষিত দ্রোণের দারিদ্রের হৃদয়বিদারক ছবি; উল্টোদিকে ব্রাহ্মণের দারিদ্রে বিত্তবানদের বিদ্রুপ— বহু প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বিপরীত কথা বলছে। এখানেই ঘটনার শেষ নয়। বিত্তবানেদের লাঞ্ছনায় পীড়িত পিতা দ্রোণের এবার এক ক্ষমাতাবানের কথা মাথায় এল। তিনি দ্রোণের বাল্যসখা, সহপাঠী এবং অধুনা পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ।প্রতিকারের আশায় ছুটলেন দ্রুপদের কাছে। কিন্তু কেবলমাত্র বন্ধু সম্বোধনের অপরাধে ক্ষমতাবান দ্রুপদ দরিদ্র দ্রোণকে অকথ্য অপমান করলেন এবং কেবলমাত্র এক রাত্রির উপযুক্ত ভোজন দিতে ইচ্ছা করলেন। যে প্রশাসন দ্রোণের মতো যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তির উপার্জনের উপায় করতে পারেনা সে প্রশাসন কী জনকল্যাণ করবে? আদৌ সে প্রশাসকের ক্ষমতায় থাকা উচিত? না কি শিক্ষিতরা দিন গুজরানের জন্য ক্ষমতাশালী ও বিত্তশালীদের দোরে দোরে ঘুরবে— এটাই অভিপ্রায়? ঠিক এখানেই দ্রোণ ষড়যন্ত্রীদের একহাত নিয়েছেন। শিক্ষিত মানেই মেধা আর ক্ষুধাকে একসাথে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে—সমাজের এই অযৌক্তিক আবদারের বিরুদ্ধে দ্রোণ সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করলেন হস্তিনাপুরে যোগ্যপদে চাকরি নিয়ে। মেধাকে তিনি ক্ষুধা নিবারণের হাতিয়ার করতে শেখালেন।
এইবার কেউ কেউ ঝাঁঝিয়ে প্রশ্ন করবেন দ্রোণের জীবনে এইটুকুই না হয় কষ্ট। এরপর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি তো প্রশ্নাতীত ক্ষমতা ভোগ করেছেন? আমি আবারও উল্টো কথা বলব। হস্তিনাপুরের রাজসভায় দ্রোণাচার্য কেবলমাত্র একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারীর উপযুক্ত সম্মান পেতেন যা তাঁর যোগ্যতাবলে পাওয়া। কিন্তু প্রশ্নাতীত ক্ষমতার অধিকারী তিনি ছিলেন না। কারণ তিনি রাজা নন। রাজা তো রাজাই। ‘মনুসংহিতা’ বলছে— ইন্দ্র, বায়ু, যম, সূর্য, অগ্নি, বরুণ, চন্দ্র ও কুবের— এই সকল দেবতার সারভূত অংশ নিয়ে পরমেশ্বর রাজাকে সৃষ্টি করেছেন (৭/৪)। সিদ্ধান্ত এই— ‘বালোঽপি নাবমন্তব্যো মনুষ্য ইতি ভূমিপঃ/ মহতী দেবতা হ্যেষা নররূপেণ তিষ্ঠতি//’ (৭/৮) অর্থাৎ রাজা নাবালক হলেও (বলা ভালো রাজপদের অনুপযুক্ত হলেও) তাঁকে সাধারণ মানুষ ভেবে অবজ্ঞা কোরো না; আসলে রাজা হলেন প্রকৃতপক্ষে একজন দেবতা যিনি মানুষের রূপে এই পৃথিবীতে অবস্থান করেন। অতএব রাজাই ঈশ্বর, রাজকর্মচারীরা নন। আবার মন্ত্রীদের সাথে পর্যালোচনা করলেও তাদের সিদ্ধান্তই যে রাজাকে মেনে চলতে হবে তাও নয়। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত রাজাই নিতেন। এক্ষেত্রে ‘মনুসংহিতা’-র সাক্ষ্য— ‘সমস্তানাঞ্চ কার্যেষু বিদধ্যাদ্ হিতমাত্মনঃ’ (৭/৫৭)। অর্থাৎ পৃথক পৃথক ভাবে বা মিলিত ভাবে মন্ত্রীদের অভিপ্রায় অবগত হয়ে রাজা নিজে যেটি হিতকর বলে মনে করবেন সেইরকম করবেন। অতএব যারা এই ধারণা পোষণ করেন যে শাসনযন্ত্রে ব্রাহ্মণরাই সর্বোচ্চ স্থানে থাকতেন এবং ব্রাহ্মণদের কথা মতো রাজারা চলতেন, তাদের বলি হিসেবটা এক আর একে দুইয়ের মতো অতটা সহজ ছিল না। যদি তাই হত তাহলে দ্রোণ, কৃপদের পরামর্শ রাজা ধৃতরাষ্ট্র বা যুবরাজ দুর্যোধন মেনে নিতেন আর কুরক্ষেত্রের যুদ্ধই হত না। পদে পদে এঁরা ধৃতরাষ্ট্রকে অন্যায় থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শিক্ষিতদের উপদেশ মোটেই ক্ষমতাশালীদের অভিপ্রেত ছিল না। ভেবে দেখুন, শাস্ত্রকারেরা ব্রাহ্মণ। কিন্তু তাঁদেরই শাস্ত্রীয় পরামর্শে ক্ষত্রিয়রা সমাজের শাসন পরিকাঠামোর সর্বেসর্বা। ব্রাহ্মণের পরামর্শ ক্ষত্রিয় শুনতেও পারে আবার নাও পারে। নিজেদের রাজা করবার এমন সুযোগ ব্রাহ্মণ শাস্ত্রকারেরা কেন হাতছাড়া করলেন? তাহলে কি মুষ্টিমেয় কিছু শিক্ষিত মানুষকে নিমিত্ত করে সমাজের ক্ষমতালোভীরা নিজেদের অভিসন্ধিকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে? কোনো রাজার পৃষ্ঠপোষকতা ও অনুমোদন ছাড়া কি কোনো নীতিশাস্ত্র রচিত বা অনুমোদিত হতে পারে? প্রশ্ন থাকছেই।
এবার আসি দ্রোণ-একলব্যের প্রসঙ্গে।দ্রোণ একলব্যের কাহিনিকে বিশ্লেষণ করে ব্রাহ্মণের জাতিবিদ্বেষ বা গুরু-শিষ্য সম্পর্কের মতো গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সম্পর্ককে কলুষিত করবার তত্ত্ব যেমন খাড়া করা যায় তেমনি এগুলির অতিরিক্ত কিছু সিদ্ধান্তেও উপনীত হওয়া যায়। ভেবে দেখুন, দ্রোণাচার্য একলব্যের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ গুরুদক্ষিণা হিসেবে নিয়ে কার স্বার্থ রক্ষা করলেন? এক ক্ষমতাশালী পরিবারের ও এক ক্ষমতার উত্তরাধিকারী বালক অর্জুনের। দ্রোণাচার্য নিজে কী পেলেন? কলঙ্ক আর সমালোচনা। আবার একলব্যের নীচুজাতির কারণে সমাজের তৈরি করা নিয়মের ইন্দ্রজালে আবদ্ধ হয়ে দ্রোণ তাঁকে সরাসরি শিক্ষাদানেও আপত্তি করলেন। ব্রাহ্মণের জাতিবিদ্বেষ তত্ত্ব আরও সুদৃঢ় হল। কিন্তু একলব্যের পরবর্তী জীবন সম্পর্কে যেসব ধারণা প্রচলিত রয়েছে সেগুলি বিশ্লেষণ করলে আশ্চর্য হতে হয়। ‘হরিবংশ’ (মহাভারতের ১৮টি পর্বের অতিরিক্ত অংশ) অনুসারে এই নীচুজাতির একলব্য জরাসন্ধের হয়ে যুদ্ধ করেছেন যখন কংশবধের প্রতিশোধ নিতে জরাসন্ধ মথুরা আক্রমণ করেন। ‘ভাগবত পুরাণ’ (মথুরা সংস্করণ) অনুসারে জরাসন্ধের বাহিনীর যোদ্ধা একলব্যকে কৃষ্ণ হত্যা করেন কারণ তিনি জানতেন একলব্যের মতো যোদ্ধা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবদের জয়ের পথে বড় বাধা হয়ে উঠতে পারেন। আবার এমন কাহিনিও প্রচলিত আছে যে, রাজপুত্র দুর্যোধন একলব্যকে হস্তিনাপুরের সমস্ত বনের রাজা ঘোষণা করেছিলেন। অর্থাৎ একলব্য কেবলমাত্র নীচজাতি হওয়ার কারণে যে সমাজব্যবস্থা ব্রাহ্মণ দ্রোণাচার্যকে তাঁকে তাঁর ছাত্ররূপে গ্রহণ করতে দিল না, সেই সমাজের ক্ষমতাবানরা কিন্তু দ্বিধাহীনভাবে তাঁর যুদ্ধের প্রতিভাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে গেল। সমাজের সকল স্তরের মানুষ বিনাপ্রশ্নে এই ষড়যন্ত্রকে মেনেও নিল! তখন তাদের জাত-কুল-মান সব হয়ে গেল গৌণ! না; একলব্য কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কর্ণের ক্ষেত্রেও সে একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হয়েছে। সূতপুত্র হওয়ার অপরাধে দ্রোণ তাকে প্রত্যাখ্যান করলেও হস্তিনাপুরের শাসকরা সময় মতো তাকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগিয়েছে। লক্ষ্যণীয়, এতে দ্রোণাচার্যের মতো ব্রাহ্মণদের সাথেই কেবল একলব্য বা কর্ণদের মতো নীচুতলার মানুষগুলোর দূরত্ব বাড়ে। আর ক্ষমতাবানেদের প্রতি বাড়ে আনুগত্য। অথচ কোন জাদুবলে জানি না, ধৃষ্টদ্যুম্নকে দ্রোণ প্রত্যাখ্যান করতে পারেন না। তাঁকেই হত্যা করবার ইচ্ছায় তাঁরই তত্ত্বাবধানে ধৃষ্টদ্যুম্নকে পাঠানো হল আর তিনি তাকে এড়িয়ে যেতে পারলেন না! ধৃষ্টদ্যুম্ন ক্ষমতাশালীর পুত্র বলেই কি দ্রোণ জানতে জানতে বিষ পান করলেন? উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী হয়েও দ্রোণ যদি এইভাবে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন তবে সমাজের বাকি শিক্ষিতদের দশা কীরূপ ছিল? সমস্ত সম্ভাবনারই পক্ষপাতহীন অনুসন্ধান প্রয়োজন।
এবার আসা যাক অভিমন্যুবধ প্রসঙ্গে। যারা দ্রোণের সেনাপতিত্বে অন্যায় যুদ্ধের তত্ত্ব কপচে বেড়ান তাদের বলি মহাভারতে অন্যায় যুদ্ধের বর্ণনা সঠিক ভাবে করলে একটি উপন্যাস হয়ে যাবে। শুধু দ্রোণকে দোষ দিলে আপনার পক্ষপাতদুষ্ট মানসিকতাই স্পষ্ট হয়। আর একটি বাস্তব কথা ভাবুন, আপনি যুদ্ধের মধ্যে নীতি-নৈতিকতা আশা করেন কী করে? সমস্ত নৈতিকতা, মানবিকতা, সহমর্মিতা যখন শেষ হয়ে যায় তখনই তো যুদ্ধের মতো নৃশংসতা নেমে আসে। অতএব নিয়ম মাফিক যুদ্ধের আশা করা মূঢ়তার নামান্তর। তবে অভিমন্যুবধের আগের কিছু ঘটনা বিশ্লেষণ করলে ক্ষমতালোভীদের যেকোনো কিছুর বিনিময়ে ক্ষমতা প্রাপ্তির এক জঘন্য প্রচেষ্টা ধরা পড়ে। ত্রয়োদশ দিনের যুদ্ধ শুরুর পূর্বেই দুর্যোধন সেনাপতি দ্রোণকে বাক্যবাণে বিদ্ধ করতে লাগলেন। কারণ কৌরবদের পরিকল্পনা অনুসারে এখনও দ্রোণ যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করতে সমর্থ হননি। দ্রোণের প্রচেষ্টার ত্রুটি ছিল না। তা সত্ত্বেও দুর্যোধনের ক্রুর বাক্যবাণে মর্মাহত দ্রোণ প্রতিজ্ঞা করলেন যে আজকের যুদ্ধে পাণ্ডবদের একজন ‘মহারথ’-কে (যিনি বহু রথীর অধিনায়ক) হত্যা করবেন। একেবারে একজন বীর যোদ্ধাসুলভ দ্রোণের এই আচরণ। পরিকল্পনা হল আজ দ্রোণ এমন এক ব্যূহ রচনা করবেন যা কয়েকজন মাত্র ভেদ করতে পারেন। কিছু যোদ্ধা অর্জুনকে যুদ্ধে ব্যস্ত রেখে ব্যূহ থেকে দূরে রাখবে। হলও তাই। দ্রোণ চক্রব্যূহ রচনা করলেন এবং যথা স্থানে উপযুক্ত যোদ্ধাদের স্থাপন করলেন। সংশপ্তকগণ অর্জুনকে যুদ্ধে ব্যস্ত রাখলেন। বেগতিক দেখে যুধিষ্ঠির ভাবলেন এই বুঝি গুরু দ্রোণাচার্য তাঁকে বন্দি করলেন। ধরা পড়ার ভয়ে আকুল হয়ে তিনি অভিমন্যুকে আদেশ করলেন চক্রব্যূহ ভেদ করতে। অভিমন্যু ভীষণ স্পষ্ট করে জানালেন তিনি চক্রব্যূহে প্রবেশের কৌশল জানলেও তার থেকে বেরিয়ে আসার পদ্ধতি তাঁর জানা নেই। কিন্তু যুধিষ্ঠির বন্দি হতে নারাজ। বন্দি হলে যুদ্ধও শেষ হবে। রাজ্য জয়ের সকল আশা ব্যর্থ হবে। তা তিনি হতে দিতে পারেন না। অতএব যে ব্যূহ সম্পর্কে তাঁর বিন্দুমাত্র ধারণা নেই, যে ব্যূহ মহাযোদ্ধা দ্রোণ রচনা করেছেন, সেই ব্যূহে তরুণ ভ্রাতুষ্পুত্রকে অবলীলায় নিক্ষেপ করলেন। যিনি নিজেকে নিজে রক্ষা করতে পারেন না তাঁর পরামর্শ মতো স্থির হল অভিমন্যু ব্যূহ ভেদ করে রাস্তা করে দেবেন আর বাকি যোদ্ধারা সেই পথে ব্যূহে প্রবেশ করে অভিমন্যুকে রক্ষা করবেন। দ্রোণের মতো যোদ্ধার সাথে যুদ্ধ করা কী এতই সহজ! কৃষ্ণের বুদ্ধিতে আর ভাইয়েদের শক্তিতে বলীয়ান যুধিষ্ঠিরের কী এমন যুদ্ধশাস্ত্রগত মেধা আছে যে দ্রোণাচার্যের তৈরি ব্যূহ ভেদ করবেন? যা ফল হওয়ার তাই হল। অভিমন্যুর তৈরি করা পথে পাণ্ডব যোদ্ধারা প্রবেশ করতে পারলেন না আর অভিমন্যুও প্রাণ থাকতে ব্যূহের বাইরে বেরোতে পারলেন না। কেউ আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আগুনকে দগ্ধ করার দায়ে অভিযুক্ত করতে পারেন কি? কিন্তু হ্যাঁ এই অভিমন্যুর জ্যেষ্ঠতাত কয়েকদিন পরেই রাজা হয়েছিলেন। আর দ্রোণ আজও কলঙ্কের ভাগিদার।
দ্রোণাচার্যের জীবনের বিভিন্ন ছোটো ছোটো ঘটনা বার বার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে শিক্ষিতদের স্থান ক্ষমতাবানদের পদতলে। সমাজের ক্ষমতাশালীরা তাদের স্বার্থে যেমন খুশি তাদের মেধা বা স্বচ্ছ ভাবমূর্তিকে ব্যবহার করতে পারে। কারণ শিক্ষিতরা দিনের শেষে বেতনভোগী কর্মচারী। রাজশেখর বসুর ‘মহাভারত’-এর সারানুবাদ থেকে জানা যায় কৌরবগণ কপট উপায়ে জয় করা ইন্দ্রপ্রস্থের দায়িত্ব দ্রোণকে দিয়েছিল। বিষয়টি তলিয়ে দেখলে অবাক হতে হয়। পঞ্চপাণ্ডবের সুযোগ্য নেতৃত্বে ইন্দ্রপ্রস্থ স্বপ্নের রাজ্যে পরিণত হয়েছিল। সুখ সমৃদ্ধিতে পূর্ণ রাজ্যের প্রজারা ভালোই ছিল। এমন সময় হঠাৎ করে তাদের রাজার সাথে কপটতা করে তাদের বনবাসে পাঠিয়ে দেওয়া হল। তাদের রাজরাণীর অপমানের কথাও তারা নিশ্চয়ই জানত। এমন অবস্থায় ইন্দ্রপ্রস্থে প্রজাবিপ্লব বা প্রজাবিক্ষোভ কি খুব স্বাভাবিক নয়? এমতাবস্থায় ইন্দ্রপ্রস্থে দরকার ছিল এক সুদক্ষ প্রশাসকের। রাজা ধৃতরাষ্ট্র নিজে অন্ধ। তিনি নিজে সম্পূর্ণ পরনির্ভরশীল। অতএব তার দ্বারা এই দায়িত্ব পালন কোনো উপায়েই সম্ভব ছিল না। দুর্যোধন নামেই নিজের মস্তক ধারণ করেন। মামা শকুনি আর বন্ধু কর্ণের বুদ্ধি ছাড়া তিনি এক পা চলতে পারেন না। অতএব এই দুর্যোগ ঠেকানো তাঁর কর্ম নয়। সুতরাং বিকল্পের সন্ধান। দ্রোণ সেক্ষেত্রে প্রথম পছন্দ। কারণ তিনি বুদ্ধিমান এবং বীর। পরিস্থিতি অনুসারে তিনি আলোচনা ও যুদ্ধ দুই বিষয়েই সমান পারদর্শী। তাছাড়া তিনি শিক্ষিত তাই সমাজে তাঁর একটা বিশেষ ইতিবাচক ভাবমূর্তি রয়েছে। অগত্যা প্রভুদের পাপের বোঝা বেতনভোগী কর্মচারীকেই নিতে হল। অনেকেই বলতে পারেন এই যুক্তি কল্পনা মাত্র।তাদের কাছে একটাই জিজ্ঞাসা; ঠিক কী কারণে এত কুমন্ত্রণা ও কপটতার পর প্রাপ্ত ইন্দ্রপ্রস্থ দুর্যোধন ভোগ করলেন না? কুটিল তর্কের খাতিরেও কেউ নিশ্চয়ই দুর্যোধনকে ত্যাগী, বিষয়ে নির্লিপ্ত বা ভোগে উদাসীন বলবেন না!
দ্রোণ আজীবন তাঁর আশ্রয়দাতাদের হিতার্থে কাজ করে গেলেন। তাঁর সমস্ত শিক্ষা উজাড় করে দিয়েছেন রাজপুত্রদের। শ্রেষ্ঠ ছাত্র অর্জুনের প্রতি তাঁর স্নেহ কখনও কখনও পুত্র অশ্বত্থামাকেও অতিক্রম করে গেছে। ধৃতরাষ্ট্র ও দুর্যোধনকে প্রতিটি অন্যায়ের পূর্বে সাধ্যমতো সতর্ক করবার সমস্ত প্রয়াস করেছেন। অন্যায় যুদ্ধ জেনেও কেবলমাত্র প্রভুদের প্রতি আনুগত্যবশত প্রাণপ্রিয় পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে সপুত্র যুদ্ধ করেছেন ও প্রাণ দিয়েছেন। কিন্তু এই আনুগত্য ক্ষমতাবান আশ্রয়দাতারা স্বীকার করল কোথায়?‘উদ্যোগপর্ব’-এ দৌত্য কর্ম শেষে সঞ্জয় যখন কৌরব সভায় পাণ্ডবদের মনোভাব স্পষ্ট করছেন তখন আসন্ন জয় পরাজয়ের চিন্তায় দোদুল্যমান রাজা ধৃতরাষ্ট্রের মনে হয়েছে দ্রোণ তাঁর দেওয়া দানের প্রতিদান হিসেবে দুর্যোধনের পক্ষে যুদ্ধ করলেও জয়লাভ করতে পারবেন কি না সে বিষয়ে তাঁর যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। যেহেতু দ্রোণ স্থবির ও অর্জুনের গুরু।ভাইয়ের ভাগ্য বিড়ম্বনাকে হাতিয়ার করে নিজের প্রতিবন্ধকতাকে অস্বীকার করে সিংহাসন আঁকড়ে থাকা ছাড়া ধৃতরাষ্ট্রের অবদান কী? তিনি কোন যোগ্যতাবলে দ্রোণাচার্যের মূল্যায়ন করেন? অন্নদাতা বলেই কি তাঁর এই দম্ভ? অথচ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ১৮ দিনের মধ্যে ৫ দিন (১১-১৫ নং দিন দ্রোণের মৃত্যু পর্যন্ত) এই বৃদ্ধের নেতৃত্বেই কৌরবরা যুদ্ধ করেছে। কৌরবদের জন্যই এই বৃদ্ধ প্রাণ দিয়েছেন। আর দুর্যোধনের কথা নাই বা বললাম। একদা অস্ত্রগুরু যে বর্তমানে তাঁর বেতনভুক্ত কর্মচারী তা তিনি পদে পদে দ্রোণকে বুঝিয়েছেন। দ্রোণের জীবদ্দশায় কোনো অস্ত্রের আঘাত হয়তো তাঁকে এতটা আঘাত করেনি যতটা আঘাত করেছে দুর্যোধনের বাক্যবাণ। শিক্ষিত কর্মচারীর মনিব যদি বুদ্ধিহীন ও ক্ষমতার গর্বে অন্ধ হয় তবে সেই কর্মচারীর অবস্থা বর্ণনার চেষ্টা না করাই ভালো।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকে কেউ ধর্মযুদ্ধ হিসেবে দেখেন তো কেউ দেখেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলাক্ষেত্র হিসেবে। আমার ধারণা খানিক ভিন্ন। এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিল কারা? পাণ্ডবপক্ষে এক ব্রাহ্মণ দ্রোণের শিষ্য ধৃষ্টদ্যুম্ন। কৌরবপক্ষে ব্রাহ্মণ পরশুরামের শিষ্য ভীষ্ম (১-১০ দিন), ব্রাহ্মণ দ্রোণ (১১-১৫ দিন), ব্রাহ্মণ পরশুরামের শিষ্য কর্ণ (১৬-১৭ দিন), শল্যের পর আরও এক ব্রাহ্মণ অশ্বত্থামা (১৮ নং দিন দুর্যোধনের পরাজয়ের পর)। যুদ্ধে ধ্বংস হল কারা? ব্রাহ্মণগুরুদের অসামান্য যোদ্ধা শিষ্যরা এবং সেনাবাহিনীতে চাকরিরত সহস্র সহস্র সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ। এই যুদ্ধ সমাজকে কতটা আঘাত করল? মানুষ দেখল যুদ্ধের নামে বিপুল আর্থিক সম্পদ, মানবসম্পদ, পশুসম্পদের অপচয়। সমাজ বুঝল ক্ষমতাশালী হতে গেলে স্নেহ, মায়া, মমতার বা শ্রদ্ধার সকল সম্পর্ককে প্রথমে হত্যা করতে হয়। স্বজন হারানো, বন্ধু হারানো, গুরু হারানো, শিষ্য হারানো, পিতা হারানো, পুত্র হারানো এই যুদ্ধ থেকে লাভবান হল কারা? কেবলমাত্র ক্ষমতাশালীরা। একদল ক্ষমতাবান যুদ্ধে পরাজিত হলেও তাদের যুদ্ধ করবার বহুদিনের বাসনা চরিতার্থ হল। আর এক দল এই যুদ্ধের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করল। যে শিক্ষিত ও শ্রমজীবীরা প্রাণ দিল তারা কী পেল? আবার এক নতুন প্রভু? এত প্রাণ নিজেদের জন্য দিতে পারলে তো নতুন প্রভুর বদলে স্বাধীনতা পাওয়া যেত! তাহলে শুধুমাত্র প্রভু পরিবর্তনের খেলায় কেন এত আত্মাহূতি? এই মানসিকতা সত্যিই অবাক করে।
যদি ৫ম খ্রিস্টপূর্বাব্দকে মহাভারতের মূল কাহিনির সময় কাল ধরে নিই তাহলে দ্রোণ আসলে সেই সময় থেকেই বিকশিত হতে চাওয়া এক প্রবণতার বীজ। দ্রোণ তৎকালীন শিক্ষিত সমাজের অন্তর্নিহিত দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করেছেন। দ্রোণ মেধাকে ক্ষুধা জয়ের অস্ত্র করেছেন। শিক্ষিত হলেই বিত্তশালী আর ক্ষমতাশালীদের পারিশ্রমিকহীন শিক্ষা প্রদান করতে হবে— সমাজের এই প্রচলিত ধারণার মূলে দ্রোণাচার্য আঘাত করেছেন। আপন যোগ্যতার বলে বলীয়ান হয়ে ক্ষমতাবানেদের থেকে রাজকীয় সম্মান ছিনিয়ে নিয়েছেন। দ্রুপদের মতো ক্ষমতাবানকে পদানত করে শিক্ষিতদের বার্তা দিয়েছেন। এরপরেও বলতে হয় কোথাও যেন প্রতিবাদের ভাষা অসম্পূর্ণ থেকে গেল। প্রশ্ন থেকে গেল অনেক। যে দ্রুপদকে বৃদ্ধ দ্রোণ কুরুক্ষেত্রের মাঠে পরাজিত করতে পারেন সেই দ্রোণের যৌবনে তাঁকে হারাতে কেন ক্ষমতাবান পরিবার থেকে আসা শিষ্যদের প্রয়োজন হল? পাঞ্চাল জয় করেও কেন দ্রুপদকে অর্ধেক রাজ্য ফিরিয়ে দিলেন? কেন একলব্য বা কর্ণকে শিষ্যরূপে গ্রহণ করে মেধাশক্তি ও পেশিশক্তির মধ্যে কৃত্রিম দূরত্ব তৈরির ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করতে পারলেন না? যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কেন দ্রোণ বেতনভোগী কর্মচারীর ভাবমূর্তি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারলেন না? এইরকম বহু প্রশ্ন আসলে এক অনুচ্চারিত, অনালোচিত রহস্যের দিকেই ইঙ্গিত করে। তবে দ্রোণ যে সমাজের ক্ষমতাশালীদের ত্রাস হয়ে উঠেছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাইতো যুধিষ্ঠিরকে হাতজোড় করে দ্রোণের কাছে তারই মৃত্যুর উপায় জানতে হয়। ধর্মযুদ্ধের নামে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে তাঁকে হত্যা করতে হয়। চুলের মুঠি ধরে মুণ্ডু কেটে ক্ষমতাবানেদের দ্রোণের মৃত্যুতে উল্লাস বুঝিয়ে দেয় এই শিক্ষিত লোকটি তাদের কতটা চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছিল। তবে এই প্রসঙ্গে আর একটি কথা না বললেই নয়। শুধুমাত্র ক্ষত্রিয়দের বাহুবলে দ্রোণকে জয় করা অসম্ভব ছিল। রাজশেখর বসুর অনুবাদ অনুসারে (দ্রোণপর্ব, দ্রোণবধপর্বাধ্যায়) পঞ্চদশদিনের যুদ্ধে ভীমের মুখে অশ্বত্থামার মৃত্যুর মিথ্যা সংবাদে প্ররোচিত না হয়ে দ্রোণ যখন ভয়ঙ্কর যুদ্ধ করছেন তখন বিশ্বামিত্র, গৌতম, ভরদ্বাজ, বশিষ্ঠ প্রমুখ মহর্ষিগণ দ্রোণের নিকট উপস্থিত হলেন (সূক্ষ্মদেহে) এবং জানালেন যে দ্রোণ যেহেতু অধর্মযুদ্ধ করছেন তাই তাঁর মৃত্যু আসন্ন। এইধরনের নেতিবাচক প্ররোচনা একজন যোদ্ধার মানসিক দুর্বলতার জন্য যথেষ্ট। মজার বিষয় হল, এইভাবে দ্রোণের উৎসাহহানি করছেন কিছু ব্রাহ্মণ! তবে কি বিপ্লব করতে চাওয়া শিক্ষিতদের বিরুদ্ধে রক্ষণশীল শিক্ষিতদের লড়িয়ে দিয়ে ক্ষমতাশালীদের ক্ষমতায় টিকে থাকার গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন দ্রোণাচার্য?যাইহোক না কেন দ্রোণকে যদি এই বিপ্লবের বীজ ধরি তবে অবশ্যই পুষ্যমিত্র সুঙ্গ তার প্রথম পরিণতি এবং পরবর্তী সময়ে কাণ্ব, সাতবাহনরা সেই পরিণতির প্রবহমান ধারা। ১৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এমনই এক ব্রাহ্মণ সেনাপতি পুষ্যমিত্র সুঙ্গ মৌর্য বংশের শেষ শাসক বৃহদ্রথকে ক্ষমতাচ্যুত করে মগধের সিংহাসনে বসেন। কিংবদন্তির যদি কিছুমাত্রও সত্যি হয় তবে কৌটিল্য নামে এক ব্রাহ্মণের মেধাশক্তিতে ভর করে নীচুতলার প্রতিনিধি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আবার পুষ্যমিত্র নামে এক ব্রাহ্মণের নেতৃত্বে ক্ষমতাবান মৌর্যরা পদানত হল। আসলে শিক্ষিত নেতা আর প্রচুর পেশিশক্তির মিলনের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে যুগান্তকারী বিপ্লবের আগুন। সেই আগুন যেকোনো বিত্তশালীর অর্থের শক্তি বা যেকোনো ক্ষমতাশালীর প্রতিরোধ শক্তিকে নিমেষে গ্রাস করতে পারে। তাই ষড়যন্ত্রীরা যুগ যুগ ধরে কখনও মেধার পক্ষ নিয়ে আবার কখনও পেশির পক্ষ নিয়ে মেধা আর পেশিকে পরস্পরের শত্রু করে রেখেছে। তাই কখনও পেশিশক্তি একত্রিত হলেও নেতার শিক্ষার অভাবে আন্দোলন উদ্দেশ্য হারায়। আবার কখনও নেতা শিক্ষিত হলেও পেশিশক্তি তাকে বিশ্বাস করতে পারে না। পক্ষপাতহীন সামগ্রিক প্রচেষ্টাই এর সমাধান করতে পারে। নিজেদের প্রশ্ন করতে হবে, আমাদের এই সঙ্কীর্ণ মানসিকতা কাদের সুবিধা করছে?
*****
Read MoreAuthor: Sovon Lal Misra
Religion Hindu Manuvad Brahmannwad মনুবাদ ব্রাহ্মণ্যবাদ দ্রোণাচার 16-August-2021 by east is rising