সমাজে কোন আইডেন্টিটা শক্তিশালী হবে তা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। এমনিতে ভাষা ও আধুনিকতার একটা সঙ্গতিপূর্ণ সম্পর্ক আছে। সাক্ষরতা বাড়লে মুখের ভাষার গুরুত্ব বাড়বে আবার আধুনিকতাও এগোবে। তাই আধুনিকতার সাথে মুখের ভাষা ভিত্তিক আইডেন্টিটির একটা ধনাত্বক সম্পর্ক আছে। ইউরোপে গুটেনবার্গের প্রিন্টিং প্রেস তাই মুখের ভাষার আইডেন্টিটি শক্তিশালী করে। ওটোমান সাম্রাজ্য পতনের মুখে আরবেও তাই হয়। অস্ট্রো হাঙ্গেরী সাম্রাজ্যের পতনের সময়ও ভাষাভিত্তিক জাতিয়তার ভিত্তি দেখা যায়।
কিন্তু ধর্মীয় আইডেন্টিটি আরও প্রাচীন এবং তা কখনোই মুছে যায়না আধুনিকতার ছোঁয়ায় বা সাক্ষরতা বাড়লে বা ভাষা ভিত্তিক আইডেন্টিটি শক্তিশালী হলে। কোন একটা বিশেষ ভাষা ভিত্তিক জাতি যদি দুই ধর্ম মতে আড়াআড়ি ভাবে বিভক্ত থাকে যেমন ৭০/৩০ বা ৬০/৪০ বা ৫০/৫০ তাহলে ধর্মীয় আইডেন্টিটি শক্তিশালী থেকে যাবেই।
দুটো কারণেঃ
১) ধর্মীয় আইডেন্টিটিকে কেন্দ্র করে দল ভারি করে দর কষাকষির স্বাভাবিক প্রবণতা দেখাবে ওই বিশেষ ভাষার মানুষ আর তাই প্রকাশ্যে বা লুকিয়ে ধর্মীয় আইডেন্টিটিকে কেন্দ্র করে সমাজ বিভাজিত থেকেই যাবে।
২) আধুনিকতার প্রথম সর্ত আদি পুঁজির সঞ্চয়ঃ আদি পুঁজি সঞ্চয় করতে গিয়ে একটা ভাষার জাতিতে সংখ্যাগুরু ধর্মের মানুষ আগে সংখ্যালঘু ধর্মের মানুষকে আক্রমণ করবে। এর কারণ জাতির বাইরের কাউকে মেরে আদি পুঁজির সঞ্চয় করার থেকে জাতির ভেতরের দুর্বল অংশকে মারা অনেক সহজ। বিশেষ করে এই ভাষার জাতিটা যদি সামরিক ভাবে দুর্বল হয় তাহলে বাইরের জাতির বা জাতিগুলোর তুলনায় তাহলে এই প্রবণতা আরও প্রকট হবে।
বাঙালি মুসলমান বর্তমান বাংলাদেশে খুব নিপুণভাবে আগে জাতির মধ্যেকার সংখ্যালঘুদের থেকে আদি পুঁজি সঞ্চয় করেছে এবং পরে বাইরের দুই জাতির (হিন্দি বনাম উর্দু)) দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে দ্বিতীয়বার আদি পুজির সঞ্চয় চালিয়েছে উর্দুদের থেকে।
পশ্চীম বঙ্গের বাঙালি হিন্দুরা হিন্দিদের লেজুড় হয়ে কোলকাতা সংলগ্ন অঞ্চলের মুসলমানদের থেকে আদি পুজির সঞ্চয়ের চেষ্টা চালায় কিন্তু স্বাধীন ভারতে ক্রমেই বাঙালি হিন্দু দেখে যে ব্রিটিশ আমলে তৈরি হওয়া সামান্য পুজিটুকুও রাজস্থানী গুজারাতিরা তাদের থেকে কেড়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমান যেমন উর্দুদের বিরুদ্ধে হিন্দিদের ভারত রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে পশ্চীম বঙ্গের বাঙালি হিন্দুরা সেরকম কোন উপায় বের করতে পারেনি হিন্দিদের বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয় কোলকাতায় মুসলমান নিধনের পরে ১৯৫০-এর দশকে যদিও পশ্চীম বঙ্গে ২৫% মুসলমান কমে ১৫% হয়ে যায় কিন্তু ২০২৩-এ এসে দেখা যাছে পশ্চীম বঙ্গে মুসলমান সংখ্যা ৩৫% হয়ে গেছে। বাঙ্গালির মধ্যেও পশ্চীম বাংলায় প্রায় ৩৫% মুসলমান। তাই পশ্চীম বঙ্গে বাঙালি জাতির মধ্যে ধর্মকে কেন্দ্র করে বেশ আড়াআড়ি বিভাজন আছে। এই অবস্থায় বাঙালি হিসেবে পশ্চীম বঙ্গে লড়াইটা আরও কঠিন হয়ে গেছে।
মনে রাখা দরকার জারমানি ও অস্ট্রিয়া একই ভাষায় কথা বললেও এক জাতি রাষ্ট্রের আওতায় আসতে পারেনি কারণ জারমানি মূলত Protestant আর অস্ত্রিয়া মূলত Catholic। নেডারল্যান্ডস ও বেলজিয়ামের বিষয়টাও প্রায় তাই। উত্তর আয়ারল্যাণ্ড ও দক্ষিণ আয়ারল্যান্ডও তাই। ক্রোট ও সার্ব জাতি একভাষি হোলেও আলাদা হয়ে গেল কারণ ক্রোটরা Catholic আর সার্বরা Orthodox।
মনে রাখা দরকার প্রাক আধুনিক যুগে খুব কম মানুষকেই পড়াশুনো করতে হত এবং ৫% লোক অধিকাংশ মানুষের মুখের ভাষার বাইরে কোন এক বিশেষ ভাষাকে সাহিত্যের ভাষা হিসেবে ব্যবহার করত। যেমন ক্যাথোলিক বিশ্বে লাতিন, অর্থোডক্স বিশ্বে গ্রিক, ইসলামিক বিশ্বে মরোক্কো থেকে শুরু করে ইরাক অবধি আরবি আর ইরান থেকে মধ্য এশিয়া ও ভারত ও ইন্দোনেশিয়া মালেশিয়াতে পার্সি, ভারতের সংস্কৃত আর চীনে ম্যাণ্ডারিন ভাষা চলত। মুখের ভাষাকে ছোট করতে এই ব্যবস্থা ছিল তা ঠিক নয়। বরং যে সমাজে ৯৫% মানুষই পড়তে পারেনা সেখানে অজস্র মুখের ভাষা শিখে তা দিয়ে লেখাটাই ছিল বোকামী। তার চেয়ে ৫% মানুষ যারা পড়তে পারে তারা কোন একটা বিশেষ ভাষাকেই লেখার জন্যে ব্যবহার করবে যা কেবলমাত্র তারা নিজেরা বুঝতে পারবে সেটাই স্বাভাবিক।
সাক্ষরতা ও আধুনিকতা আসার পরেও চীনের ম্যণ্ডারিন ও আরবি তার স্বমহিমায় রয়ে গেছে। মুখের ভাষাগুলোই বরং লেখার ভাষার মতো করে নিজেকে গড়ে নিয়েছে। ম্যণ্ডারিন চীনকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে কার্যকর হয় কিন্তু আরবি ভাষা আরব ভাষীদের (লেখার ভাষায়, মুখের ভাষায় নয়) এক করতে ব্যর্থ হয়। চীন ও আরবে এই বিপরীত ফলের কারণ ঐতিহাসিকও হোতে পারে আবার ভৌগলিকও হোতে পারে আবার দুটোই হোতে পারে আবার অর্থনৈতিকও হোতে পারে। সেটা নিয়ে আমরা এখানে কথা বলবোনা। আমরা শুধু এটাই দেখব যে ভাষা, মুখের ভাষা, লেখার ভাষা এগুলো কখনোই ঐক্যবদ্ধ জাতিসত্ত্বা বা জাতিরাষ্ট্র কোনটারই গ্যারান্টি দিতে পারেনা।
Read More
Author: Saikat Bhattacharya
Theoretical
General
25-February-2023
by east is rising