বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে যখন তৈরি হয় তখন মুজিব ও আওয়ামী লিগকে সমর্থন করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে স্বাধীন বাংলাদেশের বিরোধিতা করলেও পরে মেনে নেয়।
ক্ষমতায় আসার পরেই বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য নেতাদের হয় নিজের দিকে নিয়ে আনে নয়তো হত্যা করতে শুরু করে মুজিব।
সিরাজ সিকদার সহ অজস্র মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করে মুজিব একনায়ক হিসেবে শাসন করতে চান।
তিনি শাসন করতে চেয়েছিলেন কমিউনিস্ট বিশ্বের বাইরের সমাজতান্ত্রিকদের মতো।
সেই মতো তিনি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লিগ বা বাকশাল তৈরি করেন এবং এক পার্টি শাসন-এর দিকে এগোন।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বাকশাল-এর এক পার্টি শাসন মেনে নিতে অস্বীকার করে এবং তার বিরুদ্ধে ক্যু করে ও তাকে হত্যা করে ১৯৭৫ সালে।
তারপর দু বছর সেনাবাহিনী পুরনো আওয়ামী লিগ-এর নেতৃত্বে সরকারকে সমর্থন করে।.১৯৭৭ সালে সেনাবাহিনী প্রধান জিয়া (তিনিও জনপ্রিয় মুক্তিযোদ্ধা) বি এন পি পার্টি তৈরি করে শাসনভার হাতে তুলে নেন এবং মার্কিন ও পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করেন।
জিয়াকেও হত্যা করা হয় ১৯৮১ সালে।
এরপরে এক বছর যেতে না যেতেই বি এন পি-এর প্রধান শাসক আবদুস সাত্তার-কে উচ্ছেদ করে তারপরে এক নিরপেক্ষ প্রধানকে ক্ষমতায় রাখা হয় প্রায় দু বছর।
এর পরেই ১৯৮৩ সালে ক্ষমতা হাতে তুলে নেন সেনা প্রধান এরশাদ।
তিনি শাসন করেন প্রায় ৭ বছর জাতীয় পার্টির প্রধান হিসেবে।
১৯৮০-এর দশকের মধ্যভাগ থেকে ১৯৯০-এর দশকের প্রথম ভাগের মধ্যে আকস্মিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয় এবং ঠাণ্ডা যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জয়ী হয়।
এই সময়ের মধ্যে মার্কিন যুক্তিরাষ্ট্র নিজের এক মেরু শাসন কায়েম করাকে বৈধতা দেওয়ার জন্য সর্বত্র বহু দলীয় গণতন্ত্র-কে সমর্থন দিতে থাকে।
এমনকি তার সহযোগী সেনা শাসকদেরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বহু দলীয় গণতন্ত্র মানতে বাধ্য করে। যেমন - দঃ কোরিয়া (১৯৮০), তাইওয়ান (১৯৮৭), চিলি (১৯৯০)।
অন্যদিকে পূর্ব ইউরোপের ৮টা দেশে কমিউনিস্ট এক পার্টি শাসন উচ্ছেদ হয়ে বহু দলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়।
সোভিয়েত পতনের পরে রাশিয়াতেও বহু দলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়।
এরকম আবহাওয়ায় ১৯৯০ সালে এরশাদ-এর পতন হয় এবং বহু দলীয় গণতন্ত্র কায়েম হয় বাংলাদেশে।
১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ ক্ষমতায় থাকে বি এন পি, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত থাকে আওয়ামি।
এই দশ বছর-কে এক মেরু বিশ্বের ও নয়া উদারবাদের এবং বহু দলীয় গণতন্ত্রের স্বর্ণযুগ বলা যায়।
কিন্তু ২০০১ সালে ইসলামী শক্তি আল কায়দার নেতৃত্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে আঘাত হানে যা বাংলাদেশেও নতুন সমীকরণ তৈরি করে।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ইসলামী শক্তিকে ইসলামী সন্ত্রাসবাদ বলে চীহ্নিত করে।
ইসলামী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-কে প্রধান বিষয় হিসেবে বিবেচনা শুরু করে মার্কিন সরকার।
সেই সুযোগে ভারত দঃ এশিয়াতে মার্কিন সরকার-এর প্রধান সহযোগী হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে থাকে ইসলামী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-এ।
আফঘানিস্তানে পাকিস্তান মার্কিন সরকার-কে সমর্থনের ভান দেখিয়ে তালিবান-দের সমর্থন করতে থাকে ভেতরে ভেতরে।
ভারত সেই সুযোগে মার্কিন সরকারের আরও কাছাকাছি আসতে থাকে।
ভারত এই সময়ে মার্কিন সরকার-কে বুঝিয়ে ফেলতে সক্ষম হয় যে বাংলাদেশে ইসলামী সন্ত্রাস-কে আটকাতে গেলে জামাত-কে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে হবে এবং বি এন পি-এর থেকে আওয়ামী বেশি ভাল করে ইসলামী সন্ত্রাসকে আটকাতে পারবে।
ইতিমধ্যে ২০০১ থেক ২০০৬ এর মধ্যে বি এন পি-জামাত সরকার বাংলাদেশের শাসনে ছিল।
সেই সময় ঘটা কিছু হিন্দু বিরোধী দাঙ্গা এবং বাংলা ভাই নামের ইসলামী সন্ত্রাসীর উত্থান ভারতকে সুবিধে করে দেয় মার্কিন সরকার-কে আওয়ামীপন্থী করে তুলতে।
২০০৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাংলাদেশের ক্ষমতায় থাকে।
সেই সরকারের আমলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
এই দুই বছরে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বেশ কয়েকবার ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-কে নাস্তানাবুদ করে।
২০০৮-এর শেষে হাসিনার আওয়ামী লিগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার-এর অধীনে হওয়া নির্বাচনে বিজয়ী হয়।
২০০৯-তে ক্ষমতায় আসার এক মাসের মধ্যে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী-কে শেষ করে দেওয়া হয় বিদ্রোহ দমন করার অজুহাতে।
বলা হয় সেই সময় না কি ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী-কে ধ্বংস করার কাজে অংশ নেয়।
এও বলা হয় যে বহু চীনা ঘনিষ্ঠ অফিসার-কে হত্যা করা হয় সেই বিদ্রোহ দমন যোগ্যে।
এরপরে হাসিনাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি।
হেপাজত-এর মতো সংগঠন বিরোধিতা করায় তাদের হত্যা করে দমন করা হয়।
২০১৪ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়োগ করে নির্বাচন না করে আওয়ামী নিজের নেতৃত্বেই নির্বাচন করে।
ফলে নির্বাচনের কোনও বৈধতা থাকেনা।
বাংলাদেশের বিরোধীরা মার্কিন ও পশ্চীমের কাছে বারবার অভিযোগ জানায় কিন্তু কোনও ফল হয়না।
২০১৯-এও একইভাবে নির্বাচন করায় আওয়ামী।
বিএনেপি ও জামাত সহ সমস্ত বিরোধী দল মনে করতে শুরু করে যে চীনকে আটকাতে মার্কিন সরকার ভারতের হাতে বাংলাদেশকে তুলে দিয়েছে।
২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে অবশ্য মার্কিন সরকার বিরোধীদের বোঝাতে থাকে যে তারা বাংলাদেশকে ভারতের চোখ দিয়ে দেখবেনা।
অর্থাৎ ২০০১-এর পর থেকে মার্কিন সরকার বাংলাদেশকে ভারতের চোখেই দেখছিলঃ প্রথমে ইসলামী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আর তারপরে চীন-এর বিরুদ্ধে।
পরে বোঝা যায় যে মার্কিন সরকার-এর আসল লক্ষ্য ছিল সেন্ট মারটিন দ্বীপ এবং মার্কিন সরকার বাংলাদেশে সঠিক নির্বাচন করাতে নয় বরং আকাঙ্ক্ষিত সেন্ট মারটিন দ্বীপ পেতে আওয়ামীর সাথে দর কষাকষিতে আগ্রহী ছিল।
এছাড়াও ভারতের থেকে চীন অর্থনৈতিকভাবে অনেক শক্তিশালী বলে আওয়ামী সরকার চীনের দিকে ঝুঁকেছিল অর্থনৈতিকভাবে।
বাংলাদেশের সেনাও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়িয়ে চলে এবং বাংলাদেশ চীনা অস্ত্রের সবচেয়ে বড় খরিদ্দার হয়ে ওঠে।
চীনের থেকে সরিয়ে আনাও আসলে মার্কিন সরকারের অন্যতম সর্ত ছিল আওয়ামীর কাছে।
আওয়ামী সেন্ট মারটিন দ্বীপ মার্কিন সরকারকে দিতে অস্বীকার করলেও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক হ্রাস করার কোনও প্রতিশ্রুতি হয়তো দেয় মার্কিন সরকারকে।
আর সেই জন্যেই হয়তো আওয়ামীর তত্ত্বাবধানে হওয়া নির্বাচনে বিরোধীদের অংশ নিতে বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
নির্বাচনে জিতে এসেই ভারতে গিয়ে তিস্তা বিষয়ক বিনিয়োগ ও ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে উত্তর পূর্বাঞ্চল-কে জোড়ার জন্যে বাংলাদেশ দিয়ে রেলপথ বানাতে মৌ স্বাক্ষর করে আসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হাসিনা।
মনে রাখা দরকার ভারত দীর্ঘ দিন ধরে তিস্তার জল বাংলাদেশকে না দেওয়ায় চীন সরকার বাংলাদেশ সরকার-এর কাছে প্রস্তাব রাখে যে চীনের ইয়াংসে কিয়াং নদীর পোলিমাটি সরাতে যেরকম বিনিয়োগ করা হয়েছে সেরকমই বিনিয়োগ তিস্তায় করার।
আবার চীন সরকার ভূটানের দোকালাম দিয়ে যে শিলিগুড়ি করিডোর দখল করে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে উত্তর পূর্বাঞ্চল-কে আলাদা করে ফেলতে চাইছে বলে ধরা হয় আর তারই প্রতিরোধক হিসেবে বাংলাদেশ-এর মধ্য দিয়ে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে উত্তর পূর্বাঞ্চল-এ যাওয়ার বিকল্প রাস্তা তৈরি করতে চাইছে ভারত বলে ধরা হয়।
এদিকে ১৫ বছর ছরে বাংলাদেশে যে নতুন যুব সমাজের উদ্ভব ঘটেছে তারা একদিকে ভারতের দাদাগিরি দেখছে, অন্যদিকে দেখছে দিনের পর দিন ঠিকঠাক ভোট হচ্ছেনা।
শেষ ১৫ বছরে চীনের সাহায্যে ও জাপানের সাহায্যে আওয়ামী সরকার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামো তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।
আর সেই সুযোগে নতুন যুব সমাজ হয়ে উঠেছে অনেক বেশি ডিজিটাল।
নীম্নতম আয়ের দেশ থেকে বাংলাদেশ মধ্য নীম্ন আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে।
শুধু তাই নয় বাংলাদেশের জন প্রতি আয় ছাপিয়ে গেছে ভারতকেও।
বিশেষ করে বাংলাদেশ লাগোয়া পূর্ব ভারতের জন প্রতি আয়-কে অনেকটাই ছাপিয়ে গেছে বাংলাদেশ।
এই বিষয়টা ক্রমেই ভারতের ওপর কিভাবে চাপ বাড়াচ্ছে তা নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করব।
যাই হোক উন্নয়নের সাথে সাথে ভয়ঙ্কর মুদ্রাস্ফীতিও দেখছে বাংলাদেশ।
এর কারণ বিশ্ব অর্থনীতির মূল উৎপাদক চীনের শ্রমিকদের মজুরি বাড়ছে, চীনের সঙ্গে মার্কিন ভূরাজনীতির দ্বন্দ্বে লাগাতার আমদানীতে শুল্ক ও পালটা শুল্ক বসানো হচ্ছে, রাশিয়া ইউক্রেইন যুদ্ধের ফলে তেলের বাজারে নানা স্যাঙ্কশন করেছে পশ্চীমা দেশগুলো এবং হুথিদের লহিত সাগরে প্যালেস্তিনিদের সমর্থনে আক্রমণ জাহাজ চলাচলে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে।
এই সমস্ত বিশ্ব অর্থনীতির ঝঞ্ঝাও বাংলাদেশের ওপর এসে পড়ছে।
ফলে এক নতুন যুব শক্তির সমাবেশ শুরু হয়েছে বাংলাদেশে।
প্রথমে ২০১৭ সালের সড়োক আন্দোলন থেকে তার যাত্রা শুরু, ২০১৮-তে সরকারি চাকরিতে কোটা বিরোধিতা করে তারা বাংলাদেশের সরকারকে চাপে ফেলে দেয় ও কোটা তুলে নিতে বাধ্য করে।
২০২৪-এ কোটার পক্ষে হাই কোর্টের রায়-কে সরকারের অভিসন্ধি মনে করে আবারও যুব সমাজ পথে নামে এবং তা শেষ পর্যন্ত আওয়ামী বিরোধী আন্দোলন হয়ে যায়।
আওয়ামী সরকার-এর দলীয় গুণ্ডা বাহিনী ও পুলিশ বিজিবি আন্দোলনকারীদের সাথে এঁটে উঠতে না পেরে শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর স্মরণাপন্ন হয়।
ফলে প্রচুর প্রাণহানি ও ধরপাকড় হয় যা জন সমর্থন আরও বেশি আওয়ামীর থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
মার্কিন সরকার ও ভারত সরকার এক যোগে আওয়ামীর পাশে থাকলেও কি বাংলাদেশের নতুন যুব সমাজ আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে?
সেই সবই এখন দেখার।
Read MoreAuthor: Saikat Bhattacharya
International geopolitics General 30-July-2024 by east is rising