বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার নেত্রিত্বে সংগঠিত হওয়া বাংলাদেশ ২০২৪ বিপ্লবের চরিত্র ঠিক কি তা এখনো ভালো মতো করে উদ্ঘাটন করা হয়নি। ভাষা ভাষা কিছু কথা আছে মাত্র। আমি চেষ্টা করেছি একটা বিশ্লেষণ করার। এই বিশ্লেষণের সাথে অনেকেই সহমত হয়তো হবেননা। তবুও আমি এই লেখা লিখছি মূলত এই বিপ্লব সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে এবং এই বিপ্লব নিয়ে খুব একটা বিশ্লেষাত্বক লেখা পাইনি বলে।
প্রথমেই আসি এই বিপ্লবের অন্যান্য বিপ্লবের সঙ্গে মিল আছে এমন বিষয়গুলো সম্বন্ধে। দীর্ঘ সময় যাবত কোনও রাজনৈতিক দল বৈধ নির্বাচন না করে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে গণক্ষোভ ও বিপ্লব যথেষ্ট স্বাভাবিক একটা ঘটনা। আওয়ামী লিগ দীর্ঘ ১৫ বছর শাসন করেছে আর তার মধ্যে শেষ ১০ বছর বা শেষ তিনটে টার্ম বৈধ ভাবে ভোট করায়নি। তার ওপর যুক্ত হয়েছে আওয়ামীর ভারত চাটা নীতি। ফলে বাংলাদেশের মানুষ ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের দালাল হিসেবে আওয়ামীকে দেখতে শুরু করে। অপেক্ষাকৃত বড়ো প্রতিবেশি দেশ-এর সাম্রাজ্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহও খুবই স্বাভাবিক।
এছাড়াও মনে রাখা দরকার বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থা খুব আশাব্যঞ্জক নয়। ২০০৮-এর বিশ্ব মন্দার পর থেকে বিশ্ব বাণিজ্যের গতি কমেছে, বিশ্ব পুঁজির চলাচল ১৬ বছর পরেও ২০০৮-এর অবস্থানে পৌছয়নি।তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চীনের উচ্চ আয়ভুক্ত দেশ দেশ হয়ে যাওয়ায় চীনের মজুরি বেড়ে গেছে অনেক আর তাই বিশ্ব বাজারে দেখা দিয়েছে মুদ্রাস্ফীতি। চীন মার্কিন দ্বৈরথ এবং রুশ উইক্রেইন যুদ্ধ মুদ্রাস্ফীতিকে বাড়িয়ে তুলেছে। ফলে সুদের হার বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে বিভিন্ন দেশ আর এর ফলে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার কমছে আর পর্যাপ্ত পরিমাণে সুদের হার না বাড়ালে ছোট অর্থনীতিগুলোকে মুখোমুখি হতে হচ্ছে বিদেশী মুদ্রার সঙ্কটে। তৃতীয় বিশ্বের যুবক যুবতীদের প্রথম বিশ্বে গিয়ে রোজগার করাও কঠিন হয়ে পড়ছে কারণ প্রথম বিশ্বেও অভিবাসী বিরোধী রাজনীতি শক্তিশালী হচ্ছে। একদিকে দীর্ঘদিনের স্বল্প অর্থনৈতিক বৃদ্ধি আর অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে স্বল্প জন্মহার-এর জন্য পশ্চীমের শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে অ-শ্বেতাঙ্গ অভিবাসী বিদ্বেষ বেড়েই চলেছে। সব মিলিয়ে বর্তমান প্রজন্মের যুবারা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সন্ধিহান। আর তাই জেন-জি (যাদের জন্ম ১৯৯৭ থেকে ২০১২-এর মধ্যে) যে এই ২০২৪ সালে বেশ খানিকটা বিদ্রোহী মনন ধারণ করবে সেটাও স্বাভাবিক।
বলা যায় বাংলাদেশ ২০২৪-এর বিপ্লব হোল জেন-জি-র নেতৃত্বে হওয়া প্রথম বিপ্লব। এই বিপ্লবের ক্ষেত্রে জেন-জি-র প্রভাব এতটাই স্পষ্ট যে তাদের তিনজনকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে নেওয়া হয়েছে। তাদের থেকে মতামতও চাওয়া হচ্ছে সংবিধান সংশোধনের প্রসঙ্গে। এই ব্যপারটা বোধহয় বিশ্ব ইতিহাসে প্রথম যে নবীন প্রজন্মের থেকে শিখতে চাইছে প্রবীনেরা। নবীনেরা যেভাবে বিভিন্ন মতাবলম্বী মানুষকে একত্রিত করে এই বিপ্লব সম্পন্ন করেছে তা এক কথায় অসাধারণ। ইসলামপন্থী ও বাম্পন্থীরা এই ক্ষেত্রে এক যোগে কাজ করেছে। আন্দোলন কর্মসূচীর নেতাদের নেতা না বলে সমন্বায়ক বলা হয়েছে যা আন্দোলনকারীদের ও নেতাদের মধ্যেকার পার্থক্য ঘোচাতে সাহায্য করেছে। সমন্বায়কদের যে কজনকে সামনে দেখা গেছে তাদের মধ্যে সারজিশের লেখা পড়ে ও বক্তব্য দেখে মনে হয়েছে সে ইসলামপন্থী, আবার নাহীদ-এর বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে সে বামপন্থী। এভাবে বিভিন্ন আদর্শের মানুষ কিভাবে একসঙ্গে কাজ করতে পারল তা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। আগের প্রজন্মগুলো এইভাবে বিভিন্ন আদর্শের মানুষকে এক করতে ব্যর্থ হয়েছে। হয়তো এর কারণ লুকিয়ে আছে জেন জি-র কাছে তথ্যের প্রতুলতার জন্যে। ইন্টারনেট থেকে যে কোনও বিষয় তথ্য অনায়াসে চলে আসে জেন জি-র কাছে। আগের প্রজন্মগুলো এত সহজে তথ্য পেতনা। বুমার ও জেন এক্স তথ্যের জন্যে অনেক বেশি নির্ভর করত শিক্ষলয় (অর্থাৎ সরকার), সংগঠন ও বই-এর ওপর। ফলে তারা প্রচণ্ডভাবে বিশেষ আদর্শে ইন্ডক্ট্রিনেটেড হতো। এক আদর্শের মানুষ অন্য আদর্শের মানুষের প্রতি বৈরিতামূলক মনোভাব রেখে চলত। ফলে এক সঙ্গে তারা কাজ করার কথা ভাবোতে পারতনা। কিন্তু জেন জি অল্প বয়স থেকেই বিভিন্ন আদর্শের লেখা ও ভিডিও ইন্টারনেট থেকে পেয়ে যায় আর তাই কোনও বিশেষ আদর্শের প্রতি ঝোঁক থাকলেও অন্য আদর্শের প্রতি চরম বৈরিতামূলক মনোভাব পোষণ করেনা। এই প্রজন্মের সবাই প্রায় কম বেশি নানা আদর্শের সমাহার। শত্রু হিসেবে আওয়ামী ও ভারত যেহেতু স্থীর ছিল, জেন জি-র সকলের এক হয়ে জোট বাঁধতে অসুবিধে হয়নি। আগের প্রজন্মগুলো এই কাজটাতেই ব্যর্থ হয়েছে।
তবে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হোল এই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল মেধা ভিত্তিক সরকারী চাকরী হওয়ার প্রসঙ্গে। মনে রাখা দরকার এই মেধা প্রসঙ্গে ২০১৭ সালেও ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আওয়ামী সরকারকে কোটা তুলে নিতে বাধ্য করেছিল। সেই কোটা হাইকোর্ট মারফত আওয়ামী সরকার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করাতেই কিন্তু ছাত্র জনতা মেধার ভিত্তিতে সরকারী চাকরীর দাবীতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করে। গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ হোল মেধার ভিত্তিতে আন্দোলনে মানুষ যত সহজে রাস্তায় নেমেছে, দীর্ঘ ১০ বছর ধরে নির্বাচন না হওয়ার জন্য কিন্তু এত বড়ো আন্দোলন হয়নি। এর কারণ হয়তো এই যে বিরোধী দলগুলোর ওপরে মানূষের যথেষ্ট ভরসা ছিলনা। কিন্তু মেধা ভিত্তিক সমাজ গঠনের প্রতি মানুষের যথেষ্ট আস্থা আছে।
মেধার ভিত্তিতে সরকারী চাকরী বন্টনের বিষয়টা এতোটাই শক্তিশালী বাংলাদেশের সমাজে যে নারীও তার ১০% নারী ভিত্তিক কোটা অস্বীকার নিতে অস্বীকার করে। এবং আন্দোলনের দাবী মতো নারী কোটা ০% করে দেওয়া হয়। এই বিষয়টা বিশ্ব জুড়ে যে নারীর স্বশক্তিকরণ প্রক্রিয়া চলছে তার বিপরীত। দুনিয়া জুড়ে যে মতবাদ এখন প্রচলিত তা হোল ণারী দীর্ঘ সময় ধরে বঞ্চিত ও অবদমিত আর তাই নারীকে সবকিছুতে পুরুষের থেকে বেশি সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু এই ধারণাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বাংলাদেশের জেন জি নারীরাই প্ল্যাকার্ড হাতে বলেছে "নারী যেখানে অগ্রসর, কোটা সেখানে হাস্যকর"। বাংলাদেশের জেন জি নারী জানিইয়ে দিয়েছে যে শেষ ৫৩ বছরে নারীর পক্ষে কোটা থাকার ফলে বাংলাদেশের নারী যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে এবং ৫৩ বছর পরে আর নারীর স্বশক্তিকরণের জন্য কোটার দরকার নেই। বাংলাদেশ ২০২৪ বিপ্লব-এর এই নারীর কোটা বিরোধী অবস্থান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা এই বিপ্লবকে বিশ্বের প্রচলিত গতি থেকে আলাদা করে।
মনে রাখা দরকার নারীর কোটা ছাড়াও বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতির জন্যে কোটা রাখার প্রবণতা পশ্চীমের গণতন্ত্রগুলোতে বাড়ছে। এর একটা বড় কারণ পশ্চীমা সমাজে মূল সংখ্যাগুরু যে শ্বেতাঙ্গ জাতি তাদের জন্মহার অত্যন্ত কম এবং তাই তাদের জনসংখ্যার শেয়ার কমে যাচ্ছে। আর তাই উৎপাদন ও ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে সংখ্যালঘু জাতিগুলোর গুরুত্ব বেড়ে যাচ্ছে। তাই এই সমস্ত সংখ্যালঘু জাতিগুলোকে দলে নিতে পশ্চীমের বহু দলীয় গণতন্ত্রগুলো তাদের জন্য কোটার ওকালতি করে। বাংলাদেশে সংখ্যাগুরু বাঙালি মুসলমানেদের জনসংখ্যার শেয়ার বেড়েছে শেষ ৫৩ বছরে। বর্তমানে এই শেয়ার ৯০%-এরও বেশি। আর তাই সংখ্যালঘু জাতিগুলোকে খুশি করার দায় সমাজের নেই। জাতিগত ও উপজাতিগত বিভেদ কম থাকায় মেধা অনুযায়ী প্রাপ্তি তত্ত্ব খুব স্বাভাবিকভাবেই জায়গা পাচ্ছে বাংলাদেশে। এই মেধা অনুযায়ী সরকারী চাকরী বন্টন-এর আন্দোলন কি ক্রমেই মেধাতাত্রিক আন্দোলন শুরু করবে? অর্থাৎ শুধু সরকারী কর্মচারীরাই নয়, সাংসদদের ও মন্ত্রীদেরও মেধার প্রমাণ দিতে হবে কি? বিএনপি সভাপতি তারেক রহমান দ্বীকাক্ষিক সরকার তৈরি করার কথা বলেছেন। এবং এক কক্ষে থাকবে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আর একটি কক্ষে থাকবে এমন লোকেরা যারা কোন না কোনভাবে নিজেদের মেধা প্রমাণ করেছেন। জামাত সভাপতিও বলেছেন দেশ চালাবে মেধাবীরা। অর্থাৎ বাংলাদেশ হয়তো বহু দলীয় নির্বাচন ব্যবস্থার সাথে চীনের মেধাতন্ত্রকে মেলাবার চেষ্টা করবে আগামীদিনে।(বহুদলীয় গণতন্ত্র থেকে মেধাতন্ত্র সবই এই লেখায় আছেঃ https://www.eastisrising.in/view-news/284)
১৮ই জিলাই-এর পরে যখন অধিকাংশ সমন্বায়কদের কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছিল আওয়ামী সরকার, যখন মনে হচ্ছিল আন্দোলনকে দমন করতে সক্ষম হয়েছে সরকার, এরকম সময়েই বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে নতুন আন্দোলনের ঢেউ ওঠে। প্রচুর মৃত্যু বরণের মধ্য দিয়ে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা নতুন করে আন্দোলনকে দাঁড় করিয়ে দেয়। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের সরকারী চাকরী নিয়ে চিন্তা থাকার কথা নয়। তাদের আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কারণ বলাই যায় সরকারের দমনের ফলে যে বিশাল মৃত্যু মিছিল হয়েছে, তার বিরুদ্ধে। অপেক্ষাকৃত উচ্চ ও উচ্চমধ্যবিত্ত ছাত্রছাত্রীরা যেভাবে অপেক্ষাকৃত নীম্ন ও নীম্নমধ্যবিত্ত ছাত্রছাত্রীদের শুরু করা আন্দোলনের হ্রাস ধরে তার নজিরও খুব বেশি বিশ্ব আন্দোলনে নেই। তবে শোনা যায় বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও সমন্বায়ক নির্বাচন শুরু হয়ে গেছিল মেধা আন্দোলন শুরু হওয়ার পরে পরেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশে ছাত্রছাত্রীরা ভাড়া বাড়িতে থাকত সেখানেও বেসরকারী ও সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটা গাটছড়া তৈরি হয়ে যায়। তবে বিপ্লব শেষে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা সরকারে বা রাজনীতিতে যোগ দেওয়ায় খুব আগ্রহ দেখায়নি।
বিপ্লব পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন যে সরকার তৈরি হয়েছে তার অন্যতম দায়িত্ব হোল নতুন সংবিধান সৃষ্টি। নতুন সংবিধানের একটা জায়গা হোল ভবিষ্যতে যেন কোনো সরকার আর নির্বাচন না করে বছরের পর বছর টিকে থাকার চেষ্টা করতে না পারে। বিএনপি আর জামাত-এর কথা মতো মেধাতন্ত্রকে এর মধ্যে ঢোকানো হবে কি না সেটাই এখন দেখার।
Read MoreAuthor: Saikat Bhattacharya
Theoretical General 01-October-2024 by east is rising