লুটেরা পুঁজি, বাণিজ্য পুঁজি, উৎপাদক পুঁজি ও ফাটকা পুঁজি

যখন অর্থ আরও বেশি অর্থের জন্য বিনিয়োগ করা হয় তখন সেই অর্থকে পুঁজি বলে। অর্থাৎ যে অর্থ বিনিয়োগ করে মুনাফা বা লাভ সমেত আরও বেশি অর্থ আয় করার চেষ্টা করা হয়, সেই অর্থকে পুঁজি বলে। এবার প্রশ্ন প্রথম পুঁজি আসে কোথা থেকে? কারণ পুঁজি থাকলে মুনাফা করা সম্ভব। কিন্তু মুনাফা থেকে পুঁজি তোলা সম্ভব নয়। বলা হয় প্রথম পুঁজি আসে অন্যের সম্পত্তি হরণ করে।

একটা উন্নয়নশীল দেশ উন্নত মানের শিল্প দ্রব্য রপ্তানী করতে পারবেনা। কিন্তু বিশেষ ভৌগলিক কারণে কিছু বিশেষ দ্রব্য বা পরিষেবা রপ্তানী করতেই পারে। যেমন ভৌগলিক কারণে সিঙ্গাপুরের আছে আদর্শ বন্দর যার জন্য বন্দর পরিষেবা দিয়ে সে বিদেশী মুদ্রা আয় করে এবং তা বিনিয়োগ করে দেশকে উন্নত করে। তেমনই উপকূল আরব দেশগুলোতে বিশ্ব বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো অল্প খরচে তোলা যায় এমন তেল আছে এবং সেই তেল রপ্তানী করে বিদেশী মুদ্রা আয় করে দেশগুলো উন্নত হয়েছে। কিন্তু জনসংখ্যার তুলনায় পর্যাপ্ত পরিমাণে খনিজ সম্পদ বা বন্দর পরিষেবা খুব স্বল্প কিছু দেশেরই আছে। তাই অধিকাংশ দেশই এই সুবিধে পায়না। তাই সম্পত্তি হরণ ছাড়া উপায় থাকেনা অধিকাংশ দেশেই।

পুঁজির বিকাসের অনেকগুলো ধাপ আছে।

প্রথমে আদি পুঁজির সঞ্চয় করতে হয় লুট করে। হয় সংখ্যালঘু জাতির সম্পত্তি সংখ্যাগুরু জাতির দ্বারা লুট, নয় তো জমির মালিকের সম্পত্তি কৃষক দ্বারা দখল, নয় তো জমির মালিকের বল পূর্বক বর্গাদার উচ্ছ্বেদ। এই তিন উপায়ে বা এই তিনের মধ্যে যে কোনও একটা বা দুটো উপায়ে আদি পুঁজি যোগাড় করা প্রথম কাজ। এইভাবে প্রথমে লুটেরা পুঁজি তৈরি হয়। (O-M)

আদি পুঁজি আসার পরে সেই পুঁজি বিনিয়োগ করা হয় মূলত বাণিজ্যে আর এভাবেই বাণিজ্য পুঁজির বিকাস হয়। (M-M')

বাণিজ্য করে পুঁজি ও আভিজ্ঞতা বাড়িয়ে উৎপাদনে বিনিয়োগ শুরু করে পুঁজি। এইভাবে গড়ে ওঠে উৎপাদনকারী পুঁজি। (M-C-M')

উৎপাদনকারী পুঁজি মুনাফা যে হারে বাঁড়ায়, শ্রমিকের মজুরি সেই হারে বাঁড়াতে ব্যর্থ হয়। আবার বৃহৎ উৎপাদনকারী পুঁজি ছোট উৎপাদনকারী পুঁজিপতিকে প্রতিযোগিতায় পরাজিত করে তাকে শ্রমিক হতে বাধ্য করে। একই সাথে উৎপাদনে লাগাতার স্বয়ংক্রিয়তা বাড়িয়ে তুলে অর্থাৎ পুঁজিঃশ্রম অনুপাত বাড়িয়ে তুলে শ্রমিকের চাহিদা কম রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। ফলে শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির হার মুনাফা বৃদ্ধির হারের চেয়ে কম থাকে। আবার শ্রমিকরাই বাজারের ভোক্তা এবং মজুরি তাদের আয়। শ্রকিমকের আয় মুনাফা অর্থাৎ উৎপাদন করার ক্ষমতা থেকে পিছিয়ে পড়ে। ফলে যোগান বেশি, চাহিদা কম এমন ভয়ঙ্কর অতি উৎপাদন সঙ্কট তৈরি হয়। তখন উদ্বৃত্ত পুঁজি তৈরি হয় যা চাহিদার অভাবে লাভজনকভাবে বিনিয়োগ করা যায়না। এই উদ্বৃত্ত পুঁজি হয় শ্রমিক চালিত বা প্রভাবিত রাষ্ট্র দ্বারা অলাভজনকভাবে বিনিয়োগ করা হয় চাহিদা বাড়িয়ে যোগানের সমান করতে অথবা পুঁজি চালিত রাষ্ট্র হলে উদ্বৃত্ত পুঁজি বিনিয়োগ করা হয় লাভজনকভাবে সম্পত্তি কেনবেচার ব্যবসায়। সম্পত্তি কেনাবেচা লাভজনক হয় যদি ঋণ-এর যোগান বাড়িয়ে সম্পত্তির মূল্য বাড়িয়ে চলা হয়। এইভাবে জন্ম হয় ফাটকা পুঁজির। (M-D-M')

ফাটকা পুঁজি ঠিকঠাক লাভ পাবে কি না তা নির্ভর করে রাষ্ট্রের ঋণ করার ক্ষমতার ওপর। রাষ্ট্রের ঋণ করার ক্ষমতা নির্ভর করে সেই রাষ্ট্রের মুদ্রার ক্ষমতার ওপর। আর মুদ্রার ক্ষমতা নির্ভর করে সেই রাষ্ট্রের উৎপাদন করার ক্ষমতা ও সামরিক শক্তির ওপর। বলা বাহুল্য বর্তমানে একটা দেশই ফাটকা পুঁজিকে ঠিকঠাক লাভ দিতে পারে আর তার নাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অন্যান্য উন্নত দেশ যেমন পঃ ইউরোপ ও জাপানও উদ্বৃত্ত পুঁজির সঙ্কট দেখছে কিন্তু শক্তিশালী সামরিক শক্তি না থাকায় তারা ফাটকা পুঁজিকে লাভ দিতে পারছেনা আর তাই তাদের অর্থনীতি ক্রমশো ধ্বংসের দিকে চলেছে। চীনও উদ্বৃত্ত পুঁজির সঙ্কটে আছে কিন্তু সমাজতান্ত্রিক দেশ (রাষ্ট্র ক্ষমতা শ্রমিক শ্রেণির হাতে) হওয়ায় চীন উদ্বৃত্ত পুঁজি বিনিয়োগ করছে অলাভজনকভাবে চাহিদা নির্মাণ করতে ও উন্নত প্রযুক্তিতে সাবলম্বি হতে।

তবে মনে রাখা দরকার যে ফাটকা পুঁজির জন্ম হলে ঋণ বাড়িয়ে সম্পত্তি কেনাবেচা করে যে লাভ হয় সেই সম্পত্তির কিছু অংশ হয় উদ্ভাবনী উদ্যোগ-এর শেয়ার বা স্টক। ফলে ফাটকা পুঁজির প্রবাহ শক্তিশালী থাকলে উদ্ভাবনী উদ্যোগ কিছু অংশে লাভবান হয় কারণ সেই উদ্যোগ পুঁজির বিনিয়োগ পায়। যদিও ঋণের খুব সামান্য অংশই যায় উদ্ভাবনী উদয়গে, আর অধিকাংশই যায় প্রতিষ্ঠিত উদ্যোগের শেয়ার বা স্টকে অথবা জমি বাড়ি ধাতু ইত্যাদিতে।

আজ বাংলাদেশের মতো মোটা দাগের এক জাতির ছোট অর্থনীতির দেশগুলোতে লুটেরা-বাণিয়া পুঁজি বনাম উৎপাদনকারী পুঁজি-শ্রমিক সংগ্রাম চলছে। পাকিস্তান বা ভারতের মতো বহু জাতির ছোট বা বড় অর্থনীতিগুলোতে বিশেষ জাতি অন্য জাতিদের সম্পত্তি লুটও করছে, আবার বাণিজ্য ও উৎপাদন করেও মুনাফা করছে। বিশেষ জাতির বিরুদ্ধে অন্যান্য জাতির মুক্তির সংগ্রামও চলছে আর সাথে রয়েছে অন্যান্য জাতির পালটা আদি পুঁজি সঞ্চয়ের প্রচেষ্টা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপা্‌ন, পঃ ইউরো্‌প, দঃ কোরিয়া, চীন এখন উদ্বৃত্ত পুঁজির সঙ্কট-এর স্তরে আছে। মার্কিন রাষ্ট্র বিশাল উৎপাদন ও সমরশক্তির জোড়ে ফাটকা পুঁজিকে মুনাফা দিতে সক্ষম হচ্ছে। চীন শ্রমিক চালিত রাষ্ট্র হওয়ায় উদ্বৃত্ত পুঁজি বিনিয়োগ করছে অলাভজনকভাবে চাহিদা বাড়াতে ও প্রযুক্তিতে মার্কিনীদের সমকক্ষ হতে। বাকিরা কোনটাই করতে পারছেনা এবং ক্রমেই দুর্বল অর্থনীতিতে পরিণত হচ্ছে।

এবার প্রশ্ন হচ্ছে যে মার্কিন অর্থনীতি কি ফাটকা পুঁজিকে লাভজনক রাখতে গিয়ে অতিরিক্ত ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে পরাস্ত হবে না কি চীনের অলাভজনক বিনিয়োগ চীনের উৎপাদিকা শক্তিকে মার্কিন উৎপাদিকা শক্তির সমকক্ষ করে তুলতে সক্ষম হবে এবং মার্কিনকে ছাপিয়ে যেতে সক্ষম হবে চীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিকাস শুরু ১৭৭৬ সাল থেকে আর চীনের ১৯৪৯ সাল থেকে। অর্থাৎ মার্কিন অর্থনীতি বিকাসের পথে হাঁটছে ১৭৩ বছর আগে থেকে। আগামী ২০২৫-২০৩৫ এই সংগ্রাম চলবে এবং বিশ্বমানবতার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। চীনের বৈদেশিক আয় বেড়েই চলেছে যার অর্থ চীনের অলাভজনক বিনিয়োগ করার ক্ষমতা বেড়েই চলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পারেনি বাণিজ্য যুদ্ধ ও প্রযুক্তি যুদ্ধ করে চীনের বৈদেশিক আয় কমাতে। এবার প্রশ্ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি ঋণের যোগান অটুট রাখতে পারবে তার সমরশক্তির জোড়ে? অথবা প্রতি একক ঋণে সফল উদ্ভাবনী উদ্যোগ বেশি হবে না কি প্রতি একক অলাভজনক বিনিয়োগে সফল উদ্ভাবনী উদ্যোগ বেশি হবে?

Read More

Author: Saikat Bhattacharya

Theoretical General USA vs China 04-January-2025 by east is rising