সমাজতান্ত্রিক চীনে রাষ্ট্র একটা এআই কম্পানী ডিপসিক-কে ধরা যাক ১ লাখ টাকা দিল এবং নতুন এআই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে বলল। ডিপ্সিকপ ১ লাখ টাকার মধ্যে ২০ হাজার টাকা দিয়ে অফিস ভাড়া নিল আর বাকি ৮০ হাজার টাকা খরচ করে নতুন এ আই প্রযুক্তি উদ্ভানবন করল।
পুঁজিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটা এআই কম্পানী ওপেন-এআই শেয়ার বাজার থেকে ১ কোটি টাকা তুলল এবং ৫০ লাখ টাকা দিয়ে অফিস কিনল আর মাসে ১ লাখ টাকা দিয়ে ২০ টা সুন্দরী মেয়ে কর্মী রাখল, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা নিজেরদের মাইনে নির্ধারণ করল ২০ লাখ টাকা, প্রচুর অতিরক্ত মেশিন কিনল ৯ লাখ ২০ হাজার টাকায়। মেশিন ব্যবহার করে, সুন্দরী নিয়ে ভ্যাকেশনে গিয়ে, বিলাসবহুল পার্টি করে শেষে বাকি ৮০ হাজার টাকায় কাজটা শেষ করল।
এখানে মূল সমস্যা হল পুঁজিবাদী উদ্ভাবনী পণ্য অর্থায়নে। প্রথমেই শেয়ার/ পুঁজির বাজার থেকে অতিরিক্ত অর্থ তোলা হচ্ছে, আর তার খুব সামান্য অংশ দিয়ে মূল কাজ করা হচ্ছে। অধিকাংশ অর্থ যাচ্ছে এমন সমস্ত বিষয়ে যা না করলেও মূল কাজের কোনও ক্ষতি হতনা। এই সমস্যা এতদিন বোঝা যায়নি কারণ উদ্ভাবনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলনা। ফলে পুঁজির বাজার থেকে অতিরিক্ত পুঁজি তুলে তা খরচ করে মূল পণ্যের উৎপাদন খরচ অনেক বাড়িয়ে তোলা হত। তার থেকেও অনেক বেশি দামে মুনাফা যুক্ত করে পণ্য ভোক্তার কাছে আনা হত।
২০০৮ সালের মার্কিন শেয়ার বাজারের পতনের পরে যখন মন্দা শুরু হয়, মার্কিন সমাজ এই ফাটকা পুঁজিবাদের বিরোধিতা শুরু করে, তখন ফাটকা পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলেন যে পুঁজির বাজারে ফাটকাবাজি (সম্পত্তি হস্তান্তরের ব্যবসা) বেড়েছে, এর ফলে সম্পত্তির দাম এমন জায়গায় পৌঁছচ্ছে যে মূল দামকে তা ছাপিয়ে যাচ্ছে আর তাই বাব্বল তৈরি হচ্ছে এবং বাব্বল ফেটে গেলে মন্দা আসছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়াতেই উদ্ভাবনী পণ্য-কে সবচেয়ে ভালোভাবে অর্থায়ন করা সম্ভব। কারণ যত পণ্য উদ্ভাবন করার চেষ্টা হবে তার ১% বাজারে সফল হবে আর কোনটা সফল হবে তা আগে থেকে জানার উপায় নেই আর তাই উদ্ভাবনে অর্থায়ন করা আসলে ফাটকাবাজীই। অতএব পুঁজির বাজার থেকেই ফাটকাবাজী করে উদ্ভাবনী পণ্য-কে অর্থায়ন করে যেতে হবে। নতুন উদ্ভাবনী পণ্য আনতে গেলে পুঁজির বাজারে ফাটকাবাজীকে প্রশ্রয় দিতেই হবে।
ডিপসিক ওপেন-এআই-এর থেকেও ভাল পণ্য উদ্ভাবন করে ফেলল এক-তিরিশাংশ বিনিয়োগ খরচে। আর এখানেই প্রশ্ন আসছে মার্কিন পুঁজির বাজার এআই-এর মতো উদ্ভাবনী পণ্যের মূল্য তিরিশ গুণ বাড়িয়ে ফেলছে কেন? আসলে পুঁজির বাজার থেকে পুঁজি তুলে উদ্ভাবনী পণ্যকে অর্থায়ন করার সমস্যা হল মূল লক্ষ্য পণ্য উদ্ভাবন থাকেনা, মূল লক্ষ্য হয়ে যায় নতুন পণ্যের গল্প পুঁজির বাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে হাইপ তৈরি করায় যাতে বিনিয়োগকারীরা সবাই সেই পণ্য উদ্ভাবক কম্পানীর শেয়ার হামলে পড়ে কেনে এবং সেই কম্পানীর শেয়ার মূল্য বাড়িয়ে দেয়। শেয়ার মূল্য যত বাড়বে তত বেশি বিনিয়োগ করার মতো পুঁজি পাবে কম্পানী আত সেই বিনিয়োগের উধিকাংশই যাবে নিজেদের আয়, প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা বৃদ্ধিতে আর সামান্যই যাবে মূল পণ্য উদ্ভাবনে।
এই সমস্যা প্রথম থেকেই ছিল কিন্তু ২০০৮ সালের মন্দার পরে দেখা যাচ্ছে নতুন উদ্ভাবিত পণ্য ও পরিষেবা খাতেই ফাটকাবাজী বেশি হচ্ছে। এর ফলে উদ্ভাবন ত্বরান্বিত হয়েছে বটে কিন্তু উদ্ভাবনের উৎপাদন খরচ আর তাই ভোক্তার কাছে ধার্য মূল্য যা হওয়া উচিত তার থেকে ১০০ থেকে ৫০০ গুণ বেশি দেখাচ্ছে। মার্কিন পুঁজির বাজারের কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকাতেই এই সমস্যা তৈরি হয়েছে। ১৯৭৪ সালে সোভিয়েত ও মার্কিন সরকার নিজেদের মধ্যে পেটেন্ট আদান-প্রদানের একটা চুক্তি করে। ১৯৮৫ সালে এসে দেখা যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন রাষ্ট্রকে দিয়ে গবেষণা ও পেটেন্ট তৈরিতে প্রথম হওয়া সত্তেও পেটেন্ট ব্যবহার করে পণ্য উদ্ভাবন করায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক এগিয়ে। অর্থাৎ সোভিয়েত পেটেন্ট কিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক পণ্য উদ্ভাবন করে ফেলেছে কিন্তু সোভিয়েত মার্কিন পেটেন্ট কিনে কোনও পণ্য উদ্ভাবন করতে পারেনি। গরবাচভ সোভিয়েতে পুঁজির বাজার তৈরি করতে বলেছিল মূলত এই গবেষণায় এগিয়ে থাকা সত্তেও পণ্য উদ্ভাবনে সোভিয়েত পিছিয়ে পড়েছে বলে। অর্থাৎ এই কথা এক অর্থে তখনই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগে গবেষণা বেসরকারী বিনিয়োগের থেকে ভালো হয় বটে কিন্তু সেই গবেষণার ফল ব্যবহার করে নতুন পণ্য উদ্ভাবন করতে গেলে পুঁজির বাজারের কোনও বিকল্প নেই।
কিন্তু ডিপসিক-এর বিজয় প্রমাণ করে দিল রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগেও পণ্য উদ্ভাবন সম্ভব এবং তা এক-তিরিশাংশ কম খরচে সম্ভব। পুঁজির বাজার ফাটকাবাজী ও সম্পত্তির দামের বাব্বল তৈরির পাশাপাশি উদ্ভাবনী পণ্যের উৎপাদন খরচও বাড়িয়ে দেয়। সোভিয়েত উদ্ভাবনে ব্যর্থ হয় কারণ সোভিয়েত-এর পণ্যের বাজার ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের তুলনায় ক্ষুদ্র। চীনের রিটেইল মার্কেট বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রিটেইল মার্কেটের চেয়েও বড়। আর সোভিয়েত সরকার সরাসরি রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ করত সমস্ত ক্ষেত্রে। চীন সরকার রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ পরিকাঠামো ক্ষেত্রে সরাসরি করে, পণ্য গবেষণা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে উদ্যোগীদের হাতে রাষ্ট্র অর্থ দেয় খরচ করার জন্যে। পরিকাঠামো, গবেষণা ও উদ্ভাবন মুনাফার জন্য বিনিয়োগ করার জায়গা নয় চীনে। একমাত্র ভোগ্য পণ্যের ক্ষেত্র হল মুনাফার জন্য।
২০১৫ সালে যখন চীনের পুঁজির বাজারে ধ্বস নামে তখন প্রথম চীন সরকার পুঁজির বাজারের পর্যালোচনা করে। চীন দেখে যে আলিবাবা, টেনশেন্ট, বাইডু, ইত্যাদি বেসরকারী প্রযুক্তি কেন্দ্রিক কম্পানীগুলো মুনাফা কেন্দ্রীক হওয়ায় কোনও কঠিন উদ্ভাবন করছেনা। মুনাফা আসার সম্ভাবনা বেশি এমন উদ্ভাবনের বাইরে চিন্তা করছেনা। কিন্তু চীন-কে যদি সরবোচ্চ প্রযুক্তির স্তরে যেতে হয় তাহলে অনেক বেশি ঝুঁকি সম্পন্ন উদ্ভাবনে বিনিয়োগ করতে হবে। এই জন্যেই আসে "মেড ইন চায়না ২০২৫"। চীন ঠিক করে রাষ্ট্র বিনিয়গের অর্থ বিভিন্ন উদ্যোগী প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেবে এবং তাদের লক্ষ্য হবে সরকার নির্ধারিত সরবোচ্চ প্রযুক্তির লক্ষ্যে পৌঁছানো, মুনাফা করা নয়। ট্রাম্প ২০১৭ সালে চীনের বিরুদ্ধে প্রযুক্তি যুদ্ধ শুরু করলে এই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবারগ জানাচ্ছে যে ২০২৪-এর শেষে চীন তার "মেড ইন চায়না ২০২৫"-এর লক্ষ্যের ৯০%ই সম্পন্ন করে ফেলেছে। ডিপসিক-এর উত্থান আসলে চীনের রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে উদ্ভাবনের মডেল-এর জয়। আর তা মার্কিন পুঁজির বাজার মারফৎ উদ্ভাবনের মডেলকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিল।