
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইতালিয়াদের থেকে পাওয়া এশিয়ার পণ্য ইউরোপের সামন্তদের ও বণিকদের জীবনযাপনের মান বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু চতুর্দশ শতকে মোঙ্গল সাম্রাজ্য ভেঙ্গে যায় এবং ওসমানীয় তুর্কিদের উত্থান শুরু হয়। এর ফলে ইতালিয়দের জাঁকজমক এবং এশিয়া থেকে আগত পণ্যের পরিমাণ কিছুটা কমে। প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইউরোপে নতুন সামাজিক বিকাশ দেখা দেয়। এশিয়া থেকে পণ্যের আমদানি কমে যাওয়ায় সেখানে শহরগুলোতে শুধু বাণিজ্য নয়, কারিগরি শিল্প উৎপাদন ব্যাবস্থাও গড়ে উঠতে শুরু করে। বাল্টিক অঞ্চলে (অর্থাৎ বর্তমান জার্মানি, পোল্যান্ড, লাতভিয়া, লিথুয়ানিয়া ও এস্টনিয়া) বণিকদের বাড়বড়ন্ত দেখা যায়। বণিকরা অনেকগুলো শহরের মূল স্তম্ভ হয়ে দাঁড়ায়। ব্যাবসায়িক স্বার্থ কায়েম রাখতে ৯০টা শহর মিলে “হ্যান্সিয়াটিক লীগ” গড়ে তোলে ১৩৫৬ সালে। লীগ ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স সরকারের কাছ থেকে অনেক ব্যাবসায়িক সুবিধে ছিনিয়ে নেয় আর স্কান্ডানাভিয়ায় যুদ্ধ করে সামন্তদের কাছ থেকে অনেকগুলো দুর্গ দখল করে। এইভাবে লীগ উত্তর ইউরোপে একটা বিশাল শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। তবে লীগ আভ্যন্তরীন দ্বন্দ্বে ভেঙ্গে পড়ে শতাব্দীর শেষের দিকে। লীগের পতনে উত্তর ইউরোপের সামন্তরা হাঁফ ছেঁড়ে বাঁচে। এই দ্বন্দ্বের একটা কারণ ছিল ব্যাবসা ও কারিগরি শিল্পৎপাদন ততদিনে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সেও ছড়িয়ে পড়েছিল এবং এই নতুন প্রতিযোগিতার মুখে লীগের পক্ষে কায়েমী স্বার্থগুলোকে রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এশিয়া থেকে আমদানি করা পণ্য ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সামন্তদের বাজারজাত পণ্যের চাহিদা বাড়িয়ে দেয়। ফলে এক দিকে বণিকদের বিকাশ হয়, আর অন্যদিকে সামন্তদের কৃষকের থেকে, বণিকের থেকে ও কারিগরের থেকে চাওয়া খাজনার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। সামন্তরা নগদ অর্থ চাইতে থাকে এবং নগদ অর্থের বিনিময়ে অনেক ভূমীদাসকে মুক্তি দিতে থাকে। কিন্তু স্বাধীনভাবে কৃষিকাজ করার আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় বহু কৃষক জমি হারায় এবং মজুর কৃষকে পরিণত হয়। “ব্ল্যাক ডেথ”-এর প্রকোপে ইউরোপের জনসংখ্যা কমে যায় একতৃতীয়াংশ। এর ফলে মজুরি বেড়ে যায় বহু গুণ। মজুরির পরিমাণ নির্দিষ্ট স্তরে বেঁধে দেয় সামন্ত শাসকরা। ইংল্যান্ডের সামন্ত ও বড় কৃষকরা ছোট কৃষকদের জমি কেঁড়ে নিয়ে বেড়া দিতে থাকে। এই প্রক্রিয়াকে “এনক্লোসার মুভমেন্ট” বলা হয়। (“এনক্লোসার মুভমেন্ট” ইংল্যান্ডের আদি পুঁজির সঞ্চয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং পরবর্তী কালে শিল্পবিপ্লবের প্রাথমিক শর্ত হয়ে দাঁড়ায় আদি পুঁজির সঞ্চয়।) এর ওপর যুক্ত হয় নরম্যান্ডির ওপর দাবীকে কেন্দ্র করে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের “একশ বছর ব্যাপী যুদ্ধ”। শহরের বণিক ও কারিগর আর গ্রামের কৃষকদের ওপর ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে। ফ্রান্সে বণিক নেতা মার্শালের নেতৃত্বে ১৩৫৮ সালে জেকুয়ারী বিদ্রোহ দেখা দেয় আর ১৩৮১ সালে ইংল্যান্ডে ললারড সম্প্রদায়ের ওয়াট টাইলরের নেতৃত্বে বিদ্রোহ হয়। কিন্তু ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের সামন্ত শাসকরা বিদ্রোহ দমন করতে সমর্থ হয়। সামন্ত শাসকরা জয়ী হয় বটে, কিন্তু যুগ যে বদলাচ্ছে তার ইঙ্গিতও পাওয়া যায় এই শতকে।
Author: Saikat Bhattacharya