দ্বিজাতি তত্ত্বের মূলে হিন্দুত্ববাদ, মুসলিম লীগ নয়

12-September-2022 by east is rising 370

দ্বিজাতি তত্ত্বের জন্য স্যেকুলারপন্থীরা জিন্নাহ আর মুসলিম লীগকে দায়ী করে। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগেই হিন্দু জাতির ধারণার উদ্ভব হয়। হিন্দু শব্দটা জাতি শব্দের সমার্থক হিসেবেও ব্যবহৃত হতে থাকে। এই হিন্দুত্বের ধারণাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন সাভারকার। তিনি “হিন্দু” শব্দকে ডিফাইন করেন এভাবে “He who considers India as both his Fatherland and Holyland” এর মানে “ভারতকে পবিত্রভুমি এবং পিতৃভূমি হিসেবে যারা বিবেচনা করে তারাই হিন্দু জাতি”। Koenraad তার Decolonizing the Hindu mind বইয়ে বলেছেন এই সংজ্ঞা সকল আব্রাহামিক ধর্ম যেমন মুসলমান, খ্রিষ্টান, ইহুদীদের হিন্দু জাতিসত্বার বাইরে ঠেলে দিল। ধরে নেয়া হল তাঁরা বিদেশী। এই হিন্দু জাতি গঠনের বাইরে যাদের রাখা হল তাদেরকে তো সাভারকারই আলাদা আরেকটা জাতি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেন। হিন্দু জাতির ধারণা প্রতিষ্ঠা করার ফলেই ভারতে তার পাল্টা একাধিক জাতির ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করার অনুকুল পরিবেশ গড়ে উঠলো।

এই হিন্দুত্বের জাতিকল্পনাই এক মারাত্মক দীর্ঘমেয়াদী সমস্যার জন্ম দিয়েছে। হিন্দু ধর্ম আর জাতি যদি অভিন্ন হয় তাহলে নেপাল বলে তো কোন রাষ্ট্রের অস্তিত্বই থাকতে পারেনা। নেপাল, যা হিন্দুপ্রধান একটা দেশ যা ভারত নয় সে তো কোনভাবেই নিজেকে হিন্দু পরিচয় দেয়ার জন্য ভারতকে পিতৃভূমি আর হোলি ল্যান্ড ভাবতে পারেনা। ভারতের সাথে হিন্দু প্রধান নেপালের সমস্যার একটা ঐতিহাসিক সুত্র এখানেও থাকতে পারে। তবে যেখানে হিন্দুরা সংখ্যালঘু সেখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য অন্য সম্প্রদায়ের সাথে মিলে রাষ্ট্র গঠন এই হিন্দুত্বের সংজ্ঞার জন্য মানসিকভাবে কার্যত খুব জটিল হয়ে যায়। বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে তাঁদের পলিটিক্যাল এজেন্ট হিসেবে ভারত রাষ্ট্র একটা সম্ভাবনা হয়ে বিরাজ করতে থাকে।

হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের মুল বক্তব্য ছিলো; পৃথিবীতে হিন্দু জাতি বলে বহু প্রাচীন গরিমায় দীপ্ত এক মহান স্বতন্ত্র জাতি আছে। হিন্দু জাতির ধর্ম স্বতন্ত্র, ভাষাও স্বতন্ত্র। হিন্দু জাতি সম্পর্কিত এই ভাবনাই হিন্দুত্বের জন্ম দেয়, যার পলিটিক্যাল এক্সপ্রেশন ছিলো দ্বিজাতি তত্ত্ব, আর সেটাই হয়ে দাড়ায় ভারতভাগের কারণ। এই হিন্দু জাতীয়তাবাদই ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ব্যাকবোন।

এদিকে আমরা যদি দেখি মুসলমানদের আলীগড় আন্দোলনের নেতা সৈয়দ আহমেদ এমনকি ১৮৮৩ সালেও বলেছেন ধর্মাধর্ম নির্বিশেষে ভারতবর্ষে বসবাসরত সকলেই “একটি জাতি”। এমনকি এর অনেক পরেও ছিলো জিন্নার মুখে ঐক্যের সুর। ১৯২৮ সালের ডিসেম্বরে এক সর্বদলীয় সন্মেলনে বলেন, We are all sons of this land. We have to live together…. Belive me, there is no progress for India until the Musolmans and Hindus are united. আমরা সকলেই এই মাটির সন্তান। আমাদের একসাথেই বাঁচতে হবে…। বিশ্বাস করুন ভারতের কোন অগ্রগতি হবেনা যদি হিন্দু আর মুসলমানেরা ঐক্যবদ্ধ না হয়।

১৯৩৭ সালে আহমেদাবাদে হিন্দু মহাসভার ১৯ তম অধিবেশনে সাভারকার বলেন, “There are two antagonistic nations living side by side in India”, India cannot be assumed today to be a unitarian and homogenous nation. On the contrary, there are two nations in the main: the Hindus and the Muslims, in India…. several infantile politicians commit the serious mistake in supposing that India is already welded into a harmonious nation, or that it could be welded thus for the mere wish to do so”

“দুটি পরস্পরবিরোধী জাতি ভারতে পাশাপাশি বাস করে এসেছে, ভারতকে কখনোই একশিলা সমসত্ব জাতি হিসেবে বিবেচনা করা যাবেনা। বরং উল্টোভাবে ভারতে প্রধানত দুইটি জাতি; হিন্দু এবং মুসলমান…। কিছু বালকসুলভ রাজনীতিবিদেরা এই মারাত্মক ভ্রান্ত ধারণা পোষন করে যে, ভারত এরমধ্যেই একটি সুসমসত্ব একটি জাতি হিসেবে তৈরি হয়েছে বা তৈরি করা যেতে পারে।”

এই সভার প্রায় সতেরো বছের আগেই এসেন্সিয়ালস অফ হিন্দুত্ব নামে সাভারকারের একটা পুস্তকে দ্বিজাতি তত্ত্ব উপস্থাপন করা হয়। এবং হিন্দুদেরকে একটি জাতি হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। এই সভার তিন বছর পরে লাহোর অধিবেশনে অল ইণ্ডিয়া মুসলিম লীগের সভার জিন্নাহও সাভারকার উত্থাপিত হিন্দু মহাসভার দ্বিজাতি তত্ত্ব গ্রহণ করে।

ঘটনার পরম্পরা বিবেচনা করলে পাকিস্তান সৃষ্টির পিছনে দ্বিতীয় অবদান ভারতীয় মুসলমানদের। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রথম ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে দেন সাভারকার তার হিন্দু জাতির তত্ত্ব দিয়ে।

নেহেরু তার অটোবায়োগ্রাফিতেও লিখেছেন “Socially speaking, the revival of Indian Nationalism in 1907 was definitely reactionary” সামাজিকভাবে বলতে গেলে ১৯০৭ সালে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থান অবশ্যই প্রতিক্রিয়াশীল ছিলো।

হিন্দু মহাসভার হিন্দুত্বের চর্চাই মুসলিম লীগের প্রভাব বাড়াতে সাহায্য করে। রমেশচন্দ্র মজুমদার যিনি কোনভাবেই মুসলমান প্রেমী ছিলেন না, তিনিও স্ট্রাগল ফর ফ্রীডম বইয়ে লিখেছেন, The outburst of Hindu Mohasova served to strengthen the power and influence of Muslim League. “হিন্দু মহসভার বিস্ফোরণই মুসলিম লীগের ক্ষমতা ও শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছিলো।”

দ্বিজাতি তত্ত্বের জনক জিন্নাহ নয়; হিন্দুত্ববাদী সাভারকার। অথচ কি আশ্চর্য ভারত এবং বাংলাদেশের স্যেকুলারেরা এই দ্বিজাতি তত্ত্বের জন্ম দেয়ার জন্য জিন্নাহ আর মুসলিম লীগকেই তুলোধোনা করে সবসময়।

Author: Pinaki Bhattacharya


You may also like