
ষোড়শ শতাব্দীর সূচনাতে পঞ্চম চার্লস পিতার দিক থেকে স্পেন-এর আর মায়ের দিক থেকে পবিত্র রোম সাম্রাজ্য-এর সম্রাট হয়। ওনার নেতৃত্বে স্পেন আমেরিকা মহাদেশ জয় করে এবং সেখান থেকে বিপুল সোনা আমদানি করতে থাকে ইউরোপে। চার্লস হয়ে দাঁড়ায় ইউরোপের শ্রেষ্ঠ সম্রাট ও সমগ্র বিশ্বের একজন অন্যতম ক্ষমতাবান শাসক। কিন্তু পর্তুগাল চার্লসকে সমুদ্র পথে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে ফেলে দিচ্ছিল। পর্তুগাল এশিয়ার বন্দরগুলো দখল করতে থাকে এবং ভারত মহাসাগরে আধিপত্য কায়েম করে। এভাবে পর্তুগাল এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যেকার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রধান নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়ায়। আবার অন্যদিকে ওসমানীয় সুলতান সুলাইমান-এর নেতৃত্বে তুর্কিরা হাঙ্গেরি, সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, রোমানিয়া দখল করে নেয়। চার্লস যখন পর্তুগাল ও তুর্কিদের সাথে লড়াইতে ব্যাস্ত তখন তাকে আরেকটা বিপদের মুখে পড়তে হয়। বাইবেল-এর স্বাধীন ব্যক্ষা বেড়ে গেছিল প্রিন্টিং সস্তা হয়ে যাওয়ায়। নতুন বিশ্ব ও নতুন সমুদ্র বাণিজ্য থেকে আগত অর্থ পশ্চীমের মানুষকে অর্থমুখী করে তোলে। আর তাই ক্যাথোলিক চার্চের অর্থোপার্জনে নানা বিধিনিষেধ তাদের পছন্দ হচ্ছিলনা। তাই ক্যাথোলিক চার্চের বাইবেল বিশ্লেষণকে নাকচ করে স্বাধীন ব্যক্ষার পক্ষে কথা বলতে থাকেন উত্তর ইউরোপের মারটিন লুথার ও ক্যালভিন। এই আন্দোলনকে প্রোটেস্টান্ট আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। একদিকে অ-লাতিন জার্মান শেকড়জাত মাতৃ ভাষা্র জাতিগুলো প্রোটেস্টান্ট হয়ে যেতে শুরু করে কারণ ক্যাথোলিক চার্চ কেবল লাতিনকেই কুলীন ভাষা বলে মনে করত। আর অন্যদিকে রাজারা প্রোটেস্টান্ট আন্দোলনের মধ্যে খুঁজে পায় ক্যাথোলিক চার্চ ও পোপের কাছ থেকে পূর্ণ স্বাধীনতার ইন্ধন। চার্লস জার্মানিতে প্রোটেস্টান্ট আন্দোলন দমন করতে চেষ্টা করেন কিন্তু নির্মূল করতে ব্যর্থ হন। ইংল্যান্ড, হল্যান্ড, স্কান্ডেনাভিয়ায় প্রোটেস্টান্টরাই জয়ী হয়।
চার্লস-এর মৃত্যু হলে তাঁর পুত্র দ্বিতীয় ফিলিপ সম্রাট হন। ফিলিপ স্পেন ও পবিত্র রোম সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। উনি ১৫৭১ সালে তুর্কিদের বিরুদ্ধে নৌযুদ্ধে বিজয়ী হন এবং পর্তুগালকে স্পেনের সাথে চুক্তি করতে বাধ্য করান ১৫৮০ সালে। কিন্তু হল্যান্ডের প্রোটেস্টান্ট অঞ্চলের স্বাধীনতা ঘোষণা ঠেকাতে ব্যর্থ হন ১৫৮১ সালে। হল্যান্ডের স্বাধীনতা আন্দোলন পশ্চীমে জাতিরাষ্ট্র-এর ভিত্তি রচনা করে। ১৫৮৮ সালে ফিলিপ নৌযুদ্ধে ইংল্যান্ডের কাছে পরাস্ত হন। এরপর থেকে আটলান্টিক মহাসাগরে পশ্চীমের সামন্ততন্ত্রের প্রধান শক্তি স্পেনের আধিপত্য শেষ হয় এবং বাণিজ্য পুঁজিবাদী (merchantile capitalist) ইংল্যান্ড ও হল্যান্ডের আধিপত্য শুরু হয়।
প্রোটেস্টন্ট আন্দোলনের ফলে পোপের কর্তৃত্ব শেষ হয়, মাতৃভাষার বিকাশ হয়, জাতিরাষ্ট্রের ভিত্তি শক্তিশালী হয়, পয়সা করার জন্য যেকোন কাজ এমনকি সুদের কারবারও সামাজিক স্বীকৃতি পায়। ফলে কৃষক উচ্ছেদ করে জমি গ্রাস করায় আর কোন সামাজিক বাঁধা থাকলনা আর তাই ইংল্যান্ডে “এনক্লোসার মুভমেন্ট” আরও বৃদ্ধি পায়। এই শতকেই ইংল্যান্ডে সেক্সপিয়ার ইংরিজি ভাষার বিকাশ ঘটান তার নাটক রচনার মধ্য দিয়ে।
ষোড়শ শতাব্দীর শেষে পশ্চীমারা গোটা বিশ্বের সমস্ত মহাসাগরের শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় এবং স্বাধীন বিজ্ঞান, দর্শন, প্রযুক্তি চর্চায় প্রাচ্যের সমকক্ষ হয়ে ওঠে। সমুদ্র শাসন করলেও জমিতে তারা তখনও ভারতের মোঘল সাম্রাজ্য ও ওসমানীয় তুর্কি সাম্রাজ্য-এর সাথে পেরে উঠছিলনা। চীন সাম্রাজ্যের সাথে তারা নৌযুদ্ধেও পরাস্ত হচ্ছিল। চীন, ভারত, জাভা-বালি-সুমাত্রা-মালয়-এর উৎপাদন ব্যস্থা অনেক উন্নত ছিল পশ্চীমের তুলনায়। আর তাই এশিয়ার সাথে পশ্চীমের বাণিজ্য ঘাটতি রয়ে যেত। এই ঘাটতি পূরণ করতে পশ্চীমারা দাস ব্যবসা, লুণ্ঠন এবং জলদস্যুগিরির আশ্রয় নিতে শুরু করে।
এছাড়াও কোপার্নিকাস নামক পোল্যান্ডের বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেন যে পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে যা বাইবেলের শিক্ষার বিরোধী ছিল। বলা বাহুল্য প্রোটেস্টান্ট আন্দোলনের জনক মারটিন লুথার ও ক্যালভিন কোপারনিকাসের পাশে দাড়াননি।
Author: Saikat Bhattacharya