উদারবাদীরা কিভাবে নারীকে কমিউনিস্টদের থেকে জিতে নিল

16-October-2022 by east is rising 661

মার্ক্স তার ১৮৪৯ সালের "মজুর শ্রম ও পুঁজি" বইতে বলে গেছিলেন নারীদের শ্রম বাজারে ঢুকিয়ে পুরুষ শ্রমিকের দরকাষাকষির ক্ষমতা কমানো একদিন পুঁজিপতিদের কৌশল হয়ে উঠবে। কিন্তু কমিউনিস্টরাই ছিল বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকে নারী মুক্তির কাণ্ডারি। এর কারণ লেনিন মনে করেছিলেন যে নারীকে শ্রম বাজারে ঢোকাতে পারলে সোভিয়েত এবং অন্যান্য শিল্পে অনুন্নত জাতিগুলোর দ্রুত শিল্পায়নে সুবিধে হবে। লেনিনের মতে নারী শ্রম বাজারে শ্রমও দেবে আবার সন্তানও পালন করবে। কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের শিশুদের কিন্ডারগার্ডেনগুলো নারীদের মাতৃত্বের চাপ লাঘব করবে।

কমিউনিস্টদের এই অবস্থানে তৎকালীন বিশ্ব পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠান দুভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়। উদারবাদীরা শ্রম বাজারে নারীদের যোগদানকে যথেষ্ট ভাল চোখে দেখে। ওয়াল স্ট্রিট ও নিউ ইয়র্ক টাইমস ১৯২০-এর দশক থেকেই সোভিয়েতের এই উৎপাদনশীল মানসিকতার প্রশংসা শুরু করে।

কিন্তু রক্ষণশীলরা কমিউনিস্টদের এই নারীকে রাষ্ট্রীয় সাহায্যে শ্রম বাজারে নিয়ে আনায় তীব্র আপত্তি জানায়। তারা বলে নারীদের শ্রম বাজারে নিয়ে আনলে বাচ্চা হওয়ার প্রক্রিয়ায় বাঁধা পড়বে। যে জার্মানিতে ১৯১৭ সালে প্রথম নারী ভোটাধিকার লাভ করে সেই দেশেই নাজিরা ক্ষমতায় এসে স্থির করে নারীদের শ্রম বাজারে ঢোকানো যাবেনা। নাজি জার্মানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীনও প্রথম দু বছর নারীদের শ্রম বাজারে ঢোকায়নি। শেষ মেষ অবশ্য যুদ্ধে বিপুল সংখ্যক পুরুষ লাগায় নাজি জার্মানিও নারীদের শ্রম বাজারে ঢোকাতে বাধ্য হয়।

নাজিদের পতনের পরেও ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত রক্ষণশীলদের নারীকে শ্রম বাজারে ঢুকতে না দেওয়ার লবি পুঁজিবাদী বিশ্বে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে (বাইবেল বেল্টে যারা আজও শক্তিশালী) বেশ শক্তিশালী ছিল। তার প্রমাণ স্বরূপ বলা যায় সোভিয়েত যখন ১৯৫০-এর দশকে প্রচারে ছবি দিত পুরুষের হাতে হাতুড়ি আর নারীর হাতে কাস্তে, মারকিনীরা তখন প্রচারে ছবি দিত স্বামী ব্রেকফাস্ট খাচ্ছে, স্ত্রী খাবার বেড়ে বসে আছে আর সাথে তাদের তিন সন্তান।

১৯৬০-এর দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও মাও-এর সাংস্কৃতিক বিপ্লব পশ্চীমের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ঝড় তুলল। এই দশকের শেষের দিকেই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো নারী স্বাধীনতা সম্পূর্ণ রূপে মেনে নিতে শুরু করে। তবে পুঁজিপতিরা নারী স্বাধীনতা সমর্থন করে কারণ শ্রমিক সংখ্যা বাড়িয়ে তারা একদিকে উৎপাদন বাড়াতে পারবে আর অন্যদিকে তৎকালীন পুরুষ শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর দর কষাকষির ক্ষমতা কমাতে পারবে। এই দুই প্রক্রিয়াই তাদের মুনাফা বাড়াবে। কিন্তু উদারবাদীরা শুধু শ্রম বাজারেই নারীকে ঢোকানোর কথা বলেনি। তারা আদর্শগতভাবে কমিউনিস্টদের পরাজিত করার ছকও কষে ফেলে ওই ১৯৬০-এর দশকের শেষেই।

নারীদের ভোটাধীকার এবং শ্রম বাজারে ঢোকা নারীদের যে ক্ষমতায়ণ করে রাজনীতি ও অর্থনীতিতে তার থেকে এক ধাপ এগিয়ে যায় উদারবাদীরা। কমিউনিস্টদের থেকেও নারীদের কাছে বেশি জনপ্রিয় হতে তারা নারীদের যৌনতার ক্ষেত্রে দর কষাকষির ক্ষমতাকে বৈধতা দেয়। নারী যে কোন পোশক পরে সমস্ত পুরুষকে আকর্ষণ করতে পারবে কিন্তু আকর্ষিত পুরুষদের মধ্যে নারী যাকে পছন্দ করবে তার সাথেই কেবল প্রেম/ যৌনাচার/ বিবাহ করবে। অর্থাৎ নারী পুরুষদের যৌন খিদেকে ব্যবহার করে ইচ্ছে মতো নিজের আঁখের গোছাতে পারবে। বলাই বাহুল্য নারীর এই যৌন স্বাধীনতার ফলে ক্ষমতাবান ও অর্থবান পুরুষদেরই লাভবান হওয়ার কথা। রূপবান পুরুষদেরও সুবিধে হবে। কিন্তু অধিকাংশ গড় পরতা সাধারণ পুরুষ যারা ক্ষমতা অর্থ রূপ সমস্ত দিক থেকেই গড় পরতা তাদের অবস্থা হবে নিতান্ত করুণ। তাদের হয় নারী সঙ্গ ত্যাগ করে সম্মানের জীবন কাটাতে হবে নয় তো আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে নারী সঙ্গ লাভ করতে হয়।

বলা বাহুল্য উদারবাদীরা এই কৌশলেই নারীকে কমিউনিস্টদের থেকে নিজেদের দিকে টেনে নেয়। ছোট করে বলা যায় কমিউনিস্টরা নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিয়ে তার শোষিত অবস্থান দূর করে আর উদারবাদীরা এক ধাপ এগিয়ে নারীদের যৌনতায় দর কষাকষির ক্ষমতা দিয়ে নারীদের একটা নতুন শোষক শ্রেণিতে পরিণত করে।

এটা বুঝতে হবে যে উদারবাদীরা নারীদের শোষক বানায়নি, নারীদের ইচ্ছেই ছিল শোষক হওয়ার। নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না থাকায় এবং মাতৃত্ব পালনের সামাজিক চাপ থাকায় নারীদের শোষক হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ পায়নি বিশালভাবে। যদিও নানা গল্পে ও ধর্ম গ্রন্থে নারীদের এই যৌনতার দর কষাকষি করে পুরুষদের শোষণ করার কথা বারবার উঠে এসেছে কিন্তু তা সামাজিক রূপ পায়নি। মাতৃত্ব পালনের চাপে পরিবার থেকে অল্প বয়সেই বিয়ে দেওয়া হত নারীদের। ওই অল্প বয়সে অধিকাংশ সময়েই নারীদের পছন্দের গুরুত্ব থাকতনা, লেখাপড়া করা বা রোজগার করারও সুযোগ হতনা। কিছু ধনী পরিবারে অবশ্যই নারীদের কিছু স্বাধীনতা দেওয়া হত এবং ধনীদের মধ্যে নারীদের এই পুরুষ শোষণ আপেক্ষিকভাবে বেশি প্রকাশ পেত। ফরাসী বিপ্লবের সময় ধনী সামন্ত পরিবারের নারীদের কেচ্ছাকে ব্যঙ্গ করা ছিল মধুবিত্ত (বুর্জোয়া শব্দটার ফরাসী ভাষার অর্থ মধ্যবিত্ত) শ্রেণীর পুরুষদের অন্যতম বিষয়। নেপোলিয়নের আইন নারীদের (ধনী সামন্ত পরিবারে) অধিকার হ্রাস করে আর ১৮৩২ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কেন ধনী পরিবারের নারীদের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়। মার্ক্সও সেই পথেই ১৮৪৯ সালে বলেন নারীকে শ্রম বাজারে ঢোকানো হবে আগামীদিনে পুরুষ শ্রমিকের মজুরি বাড়নোর ক্ষমতা কমিয়ে দেওয়ার পুঁজিবাদী কৌশল। ১৮৪৮ সালের কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোতেও মার্ক্স বলেন "দুনিয়ার পুরুষ শ্রমিক এক হও" (Working men of the world unite)। আসলে ফরাসী বিপ্লবের সময় থেকেই নারীকে প্রতিক্রীয়াশীল একটা উপাদানই মনে করত বিপ্লবীরা।

Author: Saikat Bhattacharya


You may also like