
দুর্গাকে আমরা মা বলে ডাকি। দুর্গা পুজো আসলে মাতৃ পুজো। মানুষ যখন কৃষি শেখে তখন জমির উর্বরতা ও নারীর সন্তান ধারণের ক্ষমতাকে এক সূত্রে গাঁথতে থাকে। তখন থেকেই "মাটি মানে মা" তত্ত্ব সমাজে প্রসারলাভ করে। কৃষির প্রসার বাড়লে, খাদ্যোতপাদন বাড়ে, ফলে আরও বেশি জনসংখ্যা ধারণ করা সম্ভব হয়, এবং এই বর্ধমান জনসংখ্যা ব্যবহার করে আরও বেশি অঞ্চল কৃষির আওতায় আনা যায়। তাই কৃষি সমাজে মাতৃ পুজোর প্রসার বাড়তেই থাকে।
এছাড়াও কৃষি আরম্ভ হওয়ার আগে সমাজে নারী ও পুরুষ উভয়েই বহুগামী ছিল। তাই কে বাবা তা জানা যেতনা আর তাই সন্তান মাতৃ পরিচয়ে পরিচিত হোত। তাই আদি মাতাকে পুজো করাও রেওয়াজ ছিল কৃষির বিকাশের আগে থেকেই।
তবে কালের নিয়মে যখন গবাদি পশু চারণ শুরু হয়, ছোট হস্তশিল্প আস, পণ্যের সংখ্যা বাড়ে, বাণিজ্য শুরু হয়, নগর গড়ে ওঠে, সেই নগরকে ও বাণিজ্যকে রক্ষা করতে দস্যুদের সাথে যুদ্ধ করতে হয় তখন পুরুষের প্রয়োজনীয়তা বাড়ে। যোদ্ধা পুরুষ ও ব্যবসায়ী পুরুষকে বাদ দিয়ে আর সমাজ ভাবতেই পারতনা। তখন পুরুষ পুজো শুরু হয়। শেষে রাষ্ট্র গড়ে উঠলে নিরাকার দেবতা ধারনা আসে। কিন্তু সেই নিরাকার দেবতাকেও পুরুষ হিসেবেই ধারণা দেওয়া হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে। রাষ্ট্র খাজনা বাড়াতে যুদ্ধ ও ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল ছিল এবং তাই রাষ্ট্রের সাহায্যে যোদ্ধা-ব্যবসায়ী পুরুষের পুজো বিস্তারলাভ করে।
পৃথিবীর অধিকাংশ জায়গাতেই সমাজের বিকাশ হয়েছে এবং সভ্যতা কৃষি ছাড়িয়ে সমাজ গবাদি পশু চারণ, ছোট হস্তশিল্প, ব্যবসা, নগর-এর পথে এগোতে থাকে। ফলে মাতৃ পুজো ছাপিয়ে সর্বত্রই যোদ্ধা-ব্যবসায়ী পুরুষের পুজো বিস্তারলাভ করে। তবু নানাভাবে কৃষি সমাজে মাতৃ পুজো টিকে থেকেছে। গ্রাম বাংলাতেও মাতৃ পুজো সেভাবেই টিকেছিল। রাষ্ট্র নিজের ব্যবসা এবং যুদ্ধের স্বার্থে পুরুষ পুজো প্রচার করলেও কৃষি সমাজের বিশাল একটা অংশ জুড়ে মাতৃ পুজোর প্রভাব রয়ে যায়।
বাংলাতে সেভাবেই মাতৃ পুজো টিকে ছিল। কিন্তু প্রথমে মোঘল এবং পরে ব্রিটিশ আঘাতে যখন বাংলা তার স্বাধীন রাষ্ট্র হারায় তখন বাঙালিকে ব্যবসা করতে, যুদ্ধ করতে, যোদ্ধা-ব্যবসায়ী পুরুষ পুজো করতে- বলার কেউ থাকলনা। তখন সমাজের প্রান্তরে টিকে থাকা মাতৃ পুজো সমাজের একমাত্র আরাধ্য হয়ে ওঠে। বাঙালি প্রথমে যুদ্ধ ভোলে, তারপরে ব্যবসা ভোলে। এখন সরকারী চাকরীর জন্য ধর্না দিয়ে বসে আছে। সমাজের বিকাশ থেকে শিক্ষা নিলেই বোঝা যায় বাঙালির মাতৃ পুজোর বাড়বাড়ন্ত আসলে তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুর্বলতারই প্রতিক।
Author: Saikat Bhattacharya