আমাদের সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ

25-October-2022 by east is rising 337

আমাদের সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ

১. সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ হলেন সেই ব্যক্তি যিনি সর্বপ্রথম খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত বাংলা অঞ্চলের জনপদসমূহকে একত্রিত করে এই বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডকে "বাঙ্গালাহ" (বাংলা) নামে অভিহিত করেন।

২. তিনি এই অঞ্চলের একই ভাষাভাষী ও নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অধিবাসীদেরকে 'বাঙ্গালি' (বাঙালি) হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং এই সময় থেকেই পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মানুষ বাংলার অধিবাসীদের বাঙালি পরিচয়ে চিনতে শুরু করে। এভাবেই বিশ্বের বুকে বাঙালি জাতির স্বতন্ত্র জাতিগত পরিচয়ে পরিচিতি প্রদান করেছিলেন সুলতান ইলিয়াস শাহ।

৩. ইলিয়াস শাহ নিজেকে 'শাহ-ই-বাঙ্গালিয়ান' (বাঙালি জাতির শাহ) ও 'শাহ-ই-বাঙ্গালাহ' (বাংলার শাহ) ঘোষণা করেছিলেন। ইলিয়াস শাহের পূর্বে বাংলার কোনো শাসক কখনো নিজেকে বাংলার শাসক ঘোষণা করেন নি। রাজা শশাঙ্ক, পাল সম্রাটগণ ও সেন রাজারা নিজেদেরকে আখ্যায়িত করতেন 'গৌড়রাজ বা গৌড়েশ্বর হিসেবে'।

৪. সুলতান ইলিয়াস শাহ বাংলাকে এতোটা ভালোবাসতেন যে, একটি নদীর নামই তিনি দিয়েছিলেন 'বাঙ্গালি', যা আজও বহমান।

৫. প্রাচীন বাংলার বিখ্যাত বৌদ্ধ শহর বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনীর জনৈকা হিন্দু বিধবা ব্রাহ্মণ পুষ্পবতী ভট্টাচার্যকে বিবাহ করেন সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি পুষ্পবতীর নাম দেন 'ফুলওয়ারা বেগম'। ইলিয়াস শাহ্ স্ত্রী ফুলওয়ারা বেগমের নিকট থেকেই বাংলা শিখেছিলেন এবং বাংলা ভাষা শেখার পর তিনি স্ত্রীকে ডাকতেন 'ফুলমতি' নামে। ফুলমতি বেগমের গর্ভেই জন্মগ্রহণ করেন সুলতান ইলিয়াস শাহের সুযোগ্য পুত্র সুলতান সিকান্দার শাহ।

৬. তিনি বাংলার রাজধানী গৌড় থেকে পান্ডুয়ায় স্থানান্তরিত করেছিলেন এবং রাজধানী ফিরোজাবাদ (পান্ডুয়া) কে পরিণত করেছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের অত্যন্ত সমৃদ্ধ নগরীতে। তিনি প্রাচীন বাংলার সমৃদ্ধ গৌড় নগরীর পুনর্নির্মাণও করেছিলেন।

৭. ফিরোজাবাদে তিনি নির্মাণ করেছিলেন ২৭ টি হাম্মামখানা বিশিষ্ট বিখ্যাত সাতাশঘড়া প্রাসাদ।

৮. তিনিই সেই ইলিয়াস শাহ, যাঁর মুকুটে শোভা পেত পৃথিবীর দ্বিতীয় মূল্যবান হীরা- ''দরিয়া-ই-নূর''।

৯. তিনি প্রথম রাজভাষা হিসেবে বাংলার মর্যাদা দেন এবং ফার্সির পাশাপাশি বাংলাকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ব্যবহার শুরু হয় সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহের হাত ধরে।

১০. তিনি প্রথম ও একমাত্র মুসলিম শাসক যিনি নেপাল বিজয় করেছিলেন।

১১. ১৩৩৮ সালে তিনি সাতগাঁওয়ের শাসনক্ষমতা দখল করে নিজেকে রাঢ়ের স্বাধীন সুলতান ঘোষণা করেন এবং ''শামস আদ দুনিয়া ওয়া আদ দ্বীন আবু আল মুজাফফার ইলিয়াস শাহ'' উপাধি ধারণ করে দিল্লি সালতানাত থেকে পৃথক করে নিজেকে রাঢ়ের স্বাধীন সুলতান ঘোষণা করেন।

১২. ১৩৪২ সালে তিনি গৌড় আক্রমণ করেন এবং গৌড়ের সুলতান আলাউদ্দিন আলী শাহকে পরাজিত করে গৌড় দখল করে গৌড়ের সুলতান হিসেবে অধিষ্ঠিত হন।

১৩. ১৩৪৪ সালে তিনি ত্রিহুত বিজয় করেন ।

১৪. ১৩৫০ সালে গৌড়ের সুলতান ইলিয়াস শাহ্ নেপালে অভিযান পরিচালনা করেন এবং নেপালের রাজা জয়রাজ মল্লকে পরাজিত করে কাঠমুণ্ডুর পতন ঘটান। জয়রাজ মল্ল বীরত্বের সাথে লড়াই করেও শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে পলায়ন করেন।

১৫. তিনি ১৩৫০ সালে কাঠমুণ্ডুর পতন ঘটিয়ে শম্ভূনাথ মন্দির আক্রমণ করেন এবং পূর্বপ্রতিজ্ঞা অনুসারে শম্ভূনাথের মন্দির ধ্বংস করেন।
[সুলতান ইলিয়াস শাহ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যে পশুপতিনাথের সামনে এত নিরীহ মানুষকে বলি দেয়া হলো তার মূর্তি আমি নিজ হাতে ভাঙবো।]

১৬. সেসময় শৈবপ্রধান নেপালে শিবপূজাকে কেন্দ্র করে এক বিকৃত যৌনাচার উৎসব শুরু হয়েছিলো।
এই বিকৃত কামাচারকে উৎখাত করার নিমিত্তে ইলিয়াস শাহ কাঠমুণ্ডুর সকল শৈব উপাসনালয় জ্বালিয়ে দেন। কিন্তু সুলতান ইলিয়াস শাহ বৈষ্ণবদের আক্রমণ করেন নি এবং তাদের মন্দিরেরও কোনো ধরনের ক্ষতি করেন নি। বৈষ্ণবদের মন্দিরসমূহ সম্পূর্ণ নিরাপদ ছিলো।

১৭. শম্ভূনাথ মন্দির থেকে ৩০০ মণ খাটি সোনা ও প্রচুর ধন-রত্ন লাভ করে রাজধানীতে ফিরে আসেন সুলতান।

১৮. ১৩৪৯ সালে বঙ্গের সুলতান ফখরউদ্দিন মোবারক শাহ ইন্তেকাল করেন এবং তাঁর পুত্র ইখতিয়ারউদ্দিন গাজী শাহ সোনারগাঁওয়ের সিংহাসনে বসেন। ১৩৫২ সালে সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ ইখতিয়ারউদ্দিন গাজী শাহের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন এবং তাঁকে বিতাড়িত করে সোনারগাঁও দখল করেন।

১৯. তিনি ১৩৫২ সালে গৌড় ও বঙ্গ একত্রিত করে তাঁর সাম্রাজ্যের নামকরণ করেন "বাঙ্গালাহ" এবং এভাবেই গোড়াপত্তন ঘটে স্বাধীন বাংলা সালতানাতের।

২০. সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহের পূর্বে মুসলিম শাসকেরা কেবলমাত্র মুসলিমদেরই সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দিতেন। কিন্তু ইলিয়াস শাহ যোগ্য হিন্দুদের মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে উচ্চ রাজপদে নিয়োগ দান করেন।

২১. ১৩৫১ সালে মুহাম্মাদ বিন তুঘলকের মৃত্যুর পর দিল্লির সুলতান হন তাঁর চাচাত ভাই ফিরোজ বিন রজব। ১৩৫৩ সালে হিন্দুস্থানের সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক বাংলার সুলতান ইলিয়াস শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করলে ইলিয়াস শাহ তাঁর দুর্ভেদ্য দিনাজপুরের একডালা দুর্গে সপরিবারে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ফিরোজ শাহ তুঘলক একডালা দুর্গ অবরোধ করে ব্যর্থ হন এবং বর্ষাকাল চলে আসলে হিন্দুস্থানী সৈন্যরা প্রতিকূল পরিবেশে টিকতে না পেরে ইলিয়াস শাহের সাথে সন্ধি করে ফিরোজ শাহ তুঘলক দিল্লি ফিরে যান।

২২. সুলতান ইলিয়াস শাহের আধিপত্য ছিলো বেনারস পর্যন্ত, তিনি ১৩৪৫ সালে হিন্দুরাজ্য ছোটনাগপুর বিজয় করেন এবং ছোটনাগপুরকে বিহারের সাথে জুড়ে দেন। তিনি গোন্দওয়ানা রাজ্য বিজয় করেন এবং উড়িষ্যার বিস্তৃত অঞ্চল অধিকারে আনেন।

২৩. সুলতান ইলিয়াস শাহের সেনাপতি ছিলেন একজন হিন্দু ব্যক্তি, নাম শাহদেব। ১৩৫৩ সালে দিল্লিশ্বর ফিরোজ শাহ তুঘলক বাংলা আক্রমণ করলে বাংলার সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শাহদেব।

২৪. উপমহাদেশের একমাত্র হাজ্বী শাসক হলেন সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ। তাই তাঁর নামের পূর্বে সবসময় "হাজ্বী" শব্দটি যুক্ত ছিলো। [সে যুগে পবিত্র হজ্বব্রত পালন এখনকার মতো এতোটা সহজ ছিলো না। ইলিয়াস শাহই ভারতীয় উপমহাদেশের একমাত্র শাসক যিনি হজ্ব পালন করেছিলেন।]

২৫. সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ ১৩৫৬ সালে কামরূপ বিজয় করেন। উল্লেখ্য যে, কামরূপের কামাখ্যা মন্দিরে বহুকাল ধরে এক অশ্লীল ও নোংরা উপাসনা পদ্ধতি প্রচলিত আছে। সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ যখন কামরূপ বিজয়ের পরিকল্পনা করেছিলেন তখন কামাখ্যা মন্দিরের কুসংস্কারাচ্ছন্ন পূজারীদের ধারণা ছিলো, এই যৌনি মূর্তির কারণেই নাকি ইলিয়াস শাহ কামরূপ বিজয় করতে পারবেন না। কিন্তু ইলিয়াস শাহ ১৩৫৬ সালে রাজধানীর পতন ঘটিয়ে কামরূপ বিজয় করে তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।

২৫. কিছু সূত্রমতে, তাঁর আধিপত্য বেনারস নয়, বিস্তৃত ছিলো উত্তর প্রদেশের সুদূর বাহরাইচ পর্যন্ত।

একের পর এক যুদ্ধাভিযানের ফলে ১৩৫৭ সালের শেষদিকে সুলতানের শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে এবং রাজধানী ফিরোজাবাদ ত্যাগ করে তিনি চলে আসেন তাঁরই পুনর্নির্মিত ঐতিহাসিক গৌড় নগরীতে। ১৩৫৮ সালের জানুয়ারি মাসে গৌড় দুর্গেই মহান প্রতিপালকের ডাকে সাড়া দিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সুলতান। তাঁকে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিহারের হাজিপুর শহরে সমাধিস্থ করা হয়।

সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ চলে যান সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে, কিন্তু রেখে যান তাঁর প্রতিষ্ঠিত উপমহাদেশের অন্যতম ধনী ও শক্তিশালী সাম্রাজ্য- বাংলা সালতানাত।

আজ বাঙালি মুসলমান আজ তাঁর অতীত জৌলুস, বীরত্বগাঁথা ভুলে আত্মপরিচয়সংকটে জর্জরিত।

লেখক: রাজিত তাহমীদ জিত

সোর্স:
তারিখ-ই ফিরোজশাহী- জিয়াউদ্দিন বারাণী
তাবাকাত- ই নাসিরী - মিনহাজ-উস-সিরাজ
মধ্যযুগে বাংলা- খন্দকার স্বনন শাহরিয়ার
হাজার আফসারী
সিরাত-ই ফিরোজশাহী
SISB (Sultan Ilyas Shah Bangalah) Foundation
ফ্রান্সিস বুকাননের লেখা
বাংলার ইতিহাস: সুলতানী আমল - আব্দুল করিম
R. D. Banerji. বাঙ্গালার ইতিহাস (in Bengali). Vol. 2. pp. 145–146.
Abdul Karim (1959). Social History of the Muslims in Bengal (Down to A.D. 1538

Author: Rajit Tahmid Jeet


You may also like