
মার্কিন মুলুকে প্রধান বিরোধী দলনেতা এখন বন্দী। যারা নিজের দেশের প্রধান বিরোধী দলনেতা বন্দী হলে মার্কিন দেশের প্রকৃত গণতন্ত্রের স্তুতি গাইত তারা এখন কি করছে? হয়তো তারা নিজেদের সান্ত্বনা দিচ্ছে এই বলে যে ট্রাম্প একটা আলাদা বিষয় মাত্র। যদিও তারা অনেকেই হয়তো জানেনা জুলিয়ান এসেঞ্জ, এডওয়ার্ড স্নোডেন ও এন্ড্রিউ টেটের কথা। ফ্রান্সে তো বহুদিন হয়ে গেল আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশি জুলুম চালাচ্ছে। পশ্চীম বিরোধী কথা বললেই যে পুলিশ লেলিয়ে দেয় নিজের দেশের মানুষের বিরুদ্ধে এই সহজ কথাটা এখনো বহু তৃতীয় বিশ্বের মানুষেরই মাথায় নেই। কিন্তু বিষয়টা তাইই এবং এই তথাকথিত "অগণতান্ত্রিক" প্রবণতাগুলো পশ্চীমে ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাড়তেই থাকবে।
এবার প্রশ্ন কেন পশ্চীমে এই "অগণতান্ত্রিক" প্রবণতাগুলো বাড়বে? এর কারণ চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পশ্চীম ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে এবং সোভিয়েতের সাথে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে পশ্চীম নিজেই নিজেকে ভয়ঙ্কর কতগুলো জালে আটকে ফেলেছে। আরেকটা বিষয় হল শুধু কমিউনিস্ট চীনই নয়, রাজতান্ত্রিক ইসলামপন্থী উপসাগরীয় আরবও দারুণভাবে এগিয়ে আসছে। এছাড়াও উল্লেখ করা যেতে পারে সোভিয়েত পতনের পরে রাশিয়ার অবস্থা খারাপ হওয়া এবং এর ফলে "সোভিয়েত আমলই ভাল ছিল" মার্কা ধারণা রাশিয়াতে শক্তিশালি হয়েছে আর বহু দলীয় গণতন্ত্রের জায়গায় এক দলীয় তন্ত্রই রাশিয়াতে গড়ে উঠেছে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে সাদ্দাম পরবর্তী ইরাক ও গাদ্দাফি পরবর্তী লিবিয়ার হতশ্রী চেহারা যা বহু দলীয় গণতন্ত্রকে অসফল হিসেবেই প্রমাণ করেছে। চীনের মোট জনসংখ্যা ১৪০ কোটি আর পশ্চীমের মোট জনসংখ্যা ১০০ কোটি। তাই চীনের মোট উৎপাদন যে কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকেই নয়, গোটা পশ্চীমের চেয়েও বেশি হবে তা নিয়ে খুব বেশি দ্বন্দ্ব নেই কোথাও।
সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্রুত শিল্পায়ণ ও মহাকাশ প্রযুক্তির দ্বারা পশ্চীমকে চ্যলেঞ্জের মুখে ফেলে দেয় কিন্তু মনে রাখতে হবে সোভিয়েতের মোট জনসংখ্যা পশ্চীমের একতৃতীয়াংশ ছিল মাত্র আর ঐতিহাসিকভাবেও পশ্চীম শিল্পায়ণ প্রক্রিয়া শুরু করে সোভিয়েতের ১০০ বছর আগে। তাই শেষ পর্যন্ত পশ্চীম সোভিয়েতকে পরাজিত করতে পেরেছিল যদিও পশ্চীম এই জয় পেতে গিয়ে নিজেকে অনেকগুলো ভয়ঙ্কর জালে জড়িয়ে ফেলে। এক, পশ্চীম নারীকে যৌনতা নিয়ে দর কষাকষি করার অধিকার দিয়ে নিজেদেরই সামাজিক ও পারিবারিক শৃঙ্খলা ভেঙ্গে ফেলে আর দুই, চীনের ও সমগ্র তৃতীয় বিশ্বের সস্তা শ্রম ব্যবহার করে মুনাফা বাড়াতে গিয়ে চীনের ও তৃতীয় বিশ্বের অর্থনৈতিক ক্ষমতা অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে পশ্চীম।
সোভিয়েতকে হারাতে পশ্চীমের তৈরি করা এই দুই ফাঁদে এখন পশ্চীম নিজেই পড়েছে। এই ফাঁদ ছাড়াতে পশ্চীম ক্রমেই তথাকথিত অগণতান্ত্রিক আচরণ করতে বাধ্য হবে। কিভাবে? পশ্চীম ক্রমেই পরিবারবাদী বনাম ব্যক্তিবাদী, নারী বনাম পুরুষ, মুক্ত বাণিজ্য বনাম সংরক্ষণবাদী অর্থনীতি - ইত্যাদির আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের মধ্যে জড়িয়ে পড়ছে। এরকম ভয়ঙ্কর আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের মধ্যে গণতন্ত্রকে বেশি জায়গা দেওয়া মানে অচলায়তন তৈরি করা। এই অচলায়তন তৈরি হলে পশ্চীম চীনের থেকে আরও পিছিয়ে পড়বে। গণতান্ত্রিক ঢং বজায় রাখা সম্ভব যতক্ষণ না পর্যন্ত আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বড় আকাড় না নিচ্ছে।
পশ্চীম শেষ ৭৮ বছর যে একটা ঐক্যবদ্ধ সমাজ দেখেছিল তার একটা কারণ ছিল পশ্চীমের মানুষের ধারণা ছিল বাইরের দুনিয়া থেকে পাওয়ার কিছু নেই কারণ তারা পশ্চাদপদ। চীনের উত্থান, উপসাগরীয় আরবের উত্থান এবং তৃতীয় বিশ্বের সঙ্গে ব্যবধান কমে আসায় পশ্চীম দুনিয়ার মানুষ ক্রমেই বাইরের বিশ্বকে পশ্চাদপদ ভাবা ত্যাগ করছে এবং নিজেদের মধ্যে আভ্যন্তরীন দ্বন্দ্বে লীপ্ত হচ্ছে। গণতন্ত্রে বিকাস এমনিতেই ধিরে হয় আর এই ধির গতি পশ্চীমের পক্ষে স্বীকার করা সম্ভব হচ্ছিল কারণ তারা ঐতিহাসিকভাবে এগিয়ে এবং শিল্প বিপ্লব ও আধুনিকতার পথে হাটছে প্রায় ১৫০-৩০০ বছর আগে থেকে।
কিন্তু চীন ও উপসাগরীয় আরব এখন অনেকটাই পশ্চীমের কাছে চলে এসেছে আর তাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধীর গতি পশ্চীম আর মেনে নিতে পারবেনা। পশ্চীমা গণতন্ত্র ক্রমেই "সোনার পাথর বাটি"-তে পরিণত হবে খোদ পশ্চীমেই। ভারতে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। ভারত ক্রমেই এক দলীয় রাষ্ট্রে পরিণত হবে এবং হিন্দি গুজারাতি আধিপত্য চূড়ান্ত আকাড় নেবে যা ক্রমেই ভারতকে ভেঙ্গে ফেলবে। ভারতেও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাহায্যে কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা কমছে।
Author: Saikat Bhattacharya