
আদি পুঁজির সঞ্চয় অর্থনীতিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে ধরা হয়। ধ্রুপদীবাদীরা (স্মিথ, রিকারডো, মার্ক্স) এবং নয়া ধ্রুপদীবাদীরা (লিউইস) স্বীকার করে যে আদি পুঁজির সঞ্চয় ছাড়া কোন দেশে* অর্থনীতির বিকাশ হতে পারেনা। আদি পুঁজি বলতে বোঝানো হয় প্রথম পুঁজি যা বিনিয়োগ করে আধুনিক অর্থনীতির বিকাশের বা আরও সহজ করে বললে শিল্পায়ণের সূচনা হয়।
এবার প্রথম বিনিয়োগের পুঁজি আসবে কোথা থেকে? আজ একটা অনুন্নত দেশ আধুনিক যন্ত্রপাতি কিনতে চাইলে তার বিদেশী মুদ্রা লাগবে কিন্তু পর্যাপ্ত বিদেশী মুদ্রা বিশ্ব বাজার থেকে নেবে কিভাবে একটা অনুন্নত দেশ। দেশটাকে বিদেশে কিছু রপ্তানী করে বা নিজের দেশে বিদেশী বিনিয়োগ টেনে এনে বিদেশী মুদ্রা অর্জন করতে হবে।
এবার অনুন্নত দেশে অনুন্নয়নের জন্য মানুষের শ্রমের মান নীম্ন আর ক্রয় ক্ষমতা কম। তাই বিদেশীরা ভোগ্যপণ্য বিনিয়োগ করে না পাবে পর্যাপ্ত শিক্ষিত শ্রমিক আর না পাবে পর্যাপ্ত বাজার। আর পরিকাঠামো গত বিনিয়োগ থেকে লাভ আসে বিনিয়োগ করার বহু বছর পরে। যেমন শিক্ষায় বিনিয়োগ করে একটা ছাত্র বা ছাত্রীকে শিক্ষিত করতে কম করে ১৬-২০ বছর লাগবে এবং তারপরেই সে আদর্শ শ্রমিক হতে পারবে এবং অর্থনীতি তার সুফল পাবে। বিদেশী বিশেষ করে ব্যক্তিমালিকানাধীন বিনিয়োগকারীরা পরিকাঠামোতে বিনিয়োগ করতে চাইবেনা। তাই বিদেশী বিনিয়োগ থেকে বিদেশী মুদ্রা পাওয়ার আশা নেই।
বিদেশে রপ্তানী সম্ভব কি? একটা উন্নয়নশীল দেশ উন্নত মানের শিল্প দ্রব্য রপ্তানী করতে পারবেনা। কিন্তু বিশেষ ভৌগলিক কারণে কিছু বিশেষ দ্রব্য বা পরিষেবা রপ্তানী করতেই পারে। যেমন ভৌগলিক কারণে সিঙ্গাপুরের আছে আদর্শ বন্দর যার জন্য বন্দর পরিষেবা দিয়ে সে বিদেশী মুদ্রা আয় করে এবং তা বিনিয়োগ করে দেশকে উন্নত করে। তেমনই উপকূল আরব দেশগুলোতে বিশ্ব বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো অল্প খরচে তোলা যায় এমন তেল আছে এবং সেই তেল রপ্তানী করে বিদেশী মুদ্রা আয় করে দেশগুলো উন্নত হয়েছে। কিন্তু জনসংখ্যার তুলনায় পর্যাপ্ত পরিমাণে খনিজ সম্পদ বা বন্দর পরিষেবা খুব স্বল্প কিছু দেশেরই আছে। তাই অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশই এই সুবিধে পায়না।
যারা জনসংখ্যার তুলনায় এই প্রাকৃতিক সুবিধে পাচ্ছেনা তাদের জন্যই আদি পুঁজির সঞ্চয় নামক বিষয়টা আসে। কৃষির উৎপাদনশীলতা এতোটা বাড়ানো চাই যে কৃষি থেকে শ্রমশক্তি সরিয়ে নিয়ে শিল্পে ব্যবহার করা যাবে, শিক্ষা স্বাস্থ্য পরিকাঠামো উন্নয়ন চাই যাতে আধুনিক যন্ত্র ব্যবহারে পারদর্শী শ্রমিক শ্রেণি গড়ে ওঠে এবং নারীকে শ্রম বাজারে ঢোকানো যাতে একদিকে জন্মহার কমবে আর অন্যদিকে আধুনিক কাজে শ্রমিক সংখ্যা বাড়বে।
কৃষি থেকে শিল্পে শ্রম শক্তি নিয়ে যেতে গেলে কৃষক প্রতি উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশটার তো আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি কেনার মতো বিদেশী মুদ্রা নেই। অতএব কোন আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়া প্রাথমিক উন্নয়নের কাজ করতে হবে। এই কাজটা করার ক্ষেত্রে ভূমি সংস্কারের গুরুত্ব অপরিসীম কারণ কোন বিনিয়োগ ছাড়া শুধুমাত্র মালিকানা জমিদারের কাছ থেকে কৃষককে দিয়ে কৃষককে আরও বেশি উৎপাদন করতে উদ্বুদ্ধ করে ভূমি সংস্কার। তাই চীন বা দক্ষিণ কোরিয়া উভয়েরই সাফল্যের বড়ো কারণ হল এই ভূমি সংস্কার। নেপোলিয়ন ভূমি সংস্কারকে গুরুত্ব দিয়েছেন এবং উদারবাদী আন্দোলনগুলো উনবিংশ শতকে একে গুরুত্ব দেয়। বিংশ শতকে আবার মার্ক্সবাদী লেনিনবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রেও ভূমি সংস্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কৃষক প্রতি উতপাদন বাড়ায় বহু কৃষককে শিল্পের শ্রমিক হিসেবে নিযুক্ত করা সম্ভব হয় এবং শিল্প গড়ে ওঠে।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিকাঠামো উন্নয়নের ক্ষত্রেও বিপুল বিনিয়োগ করতে হবে দেশটাকে কোন সরাসরি লাভ ছাড়াই। শুধু তাই না, সীমিত সম্পদ থেকে এই বিনিয়োগ করতে হবে। অর্থাৎ ভোগ্য পণ্য উৎপাদন কমিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিকাঠামোতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এখানেই সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো ১৯৩০ এর দশক থেকে ১৯৬০ এর দশক পর্যন্ত অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছিল। কারণ শ্রেণি সংগ্রামের নামে তারা ধনী শ্রেণিগুলোর ক্ষমতা কেড়ে নেয় আর এর ফলে ভোগ্য পণ্য কেনার ও উৎপাদন করার প্রবণতা সমাজে কমে যায়। রাষ্ট্র অর্থনীতিতে এসে লাভ না হোলেও পরিকাঠামোতে বিনিয়োগ করে যায় যা ব্যক্তিমালিকানাধীন বিনিয়োগকারী করতনা। এই সাফল্যই তৎকালীন সমাজকে মার্ক্সবাদ লেনিনবাদের প্রতি টেনে আনে।
নারীকে শ্রম বাজারে নিয়ে আনার দুটো গুণ। এক, তা শিল্প শ্রমিকের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়ে দ্রুত বিকাশের সহায়ক আর অন্যদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমিয়ে দেয় যার ফলে কৃষিকে সমস্ত মানুষকে খাওয়ানোর চাপ কমে (যদিও কৃষিতে নিযুক্ত লোকের সংখ্যা কমবে কিন্তু জনসংখ্যার হার বেশি হলে কৃষিকে উতপাদন বাড়িয়ে যেতে হবে লাগাতার) আর শ্রমিক প্রতি পরিকাঠামো বাড়বে যা শ্রমিক প্রতি উতপাদন বাড়াবে।
এটাই কারণ বিংশ শতকের মার্ক্সবাদী লেনিনবাদী বিপ্লবের মূল বিষয় ছিল ভূমি সংস্কার, ভোগ্য পণ্য ব্যবহার কম করে শিক্ষা স্বাস্থ্য ও পরিকাঠামো উন্নয়ন এবং নারী মুক্তি। বিভিন্ন দেশ এই তিনটের সবকটা বা কিছু না কিছু গ্রহণ করে দ্রুত উন্নয়নের জন্য। দক্ষিন কোরিয়া তিনটেই গ্রহণ করে ১৯৬৯ পর্যন্ত, ভারত ভূমি সংস্কার ছাড়া বাকি দুটো গ্রহণ করে ১৯৮৫ পর্যন্ত।
এই তিনটে কাজ যেখানে যতবেশি হয়েছে সেখানেই খোলা বাজার অর্থনীতি তারপর থেকে তত বেশি সফল হয়েছে। চীন ৩ দশক ধরে (১৯৫০ থেকে ১৯৮১) শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিকাঠামোয় ভারতের চেয়ে অনেক বেশি বিনিয়োগ করতে পেরেছে বলেই ১৯৮২ থেকে চীন বিশ্ব বাজারে রাপ্তানী বাড়াতে পেরেছে যা ভারত ১৯৮৫ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত পারেনি। এটা বোঝার একটা সূচক অর্থনীতিতে আছে যার নাম gross or net fixed investment as percentage of GDP। এটা যার যত বেশি তার অর্থনৈতিক বিকাশে সাফল্য তত বেশি। দেখা যায় gross fixed investment as percentage of GDP চীনের ১৯৬০ এর দশকে যেখানে ২৬.৫%, সেখানে ভারতের মাত্র ১৮%। তেমনই চীনের ১৯৭০ এর দশকে যেখানে ৩৫% সেখানে ভারতের মাত্র ২৫%। পাকিস্তানের কিন্ত যথাক্রমে আরও কম ছিল ১৭% ও ১৫%।
এই কারণেই চীন বা ভিয়েতমানের সাফল্য পায় বিশ্ব বাজারে ঢুকে আর উত্তর কোরিয়া বা কিউবা টিকে থাকতে পারে বিশ্ব বাজার ছাড়া (মার্কিন স্যাঙ্কশনের জন্য)।
এবার আসি আরও আদি একটা বিষয়ে। *আমরা ধরে নিয়েছি একটা অনুন্নত দেশকে যার একটা রাষ্ট্র আছে। কিন্তু একটা দেশে হতেই পারে অনেক জাতি (ভাষা হোক বা ধর্ম) আছে এবং সবার রাষ্ট্রের ওপর লাগাম সমান নয়। তাহলে এই জাতিগুলো কি করবে এবং তার সাথে আদি পুঁজির সঞ্চয় কিভাবে সম্পর্কিত। তা বুঝতে লিখছি পর্ব ২।
Author: Saikat Bhattacharya