
প্রথম পর্বে আমার আলোচনার বিষয় ছিল মূলত বিংশ শতাব্দীর আদি পুঁজির সঞ্চয়। সেখানে মূল লক্ষ্য ছিল দ্রুত শিল্পায়ণ এবং সেই লক্ষ্যে ভূমি সংস্কার, শিক্ষা স্বাস্থ্য পরিকাঠামোতে বিনিয়োগ ও নারী মুক্তি। কিন্তু সেখানে আমরা একটা স্বাধীন দেশ ধরে নিয়েছিলাম যার একটা স্বাধীন রাষ্ট্র আছে। দ্বিতীয় পর্বে আমরা আলোচনা করব একটা স্বাধীন দেশের স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরি হয় কিভাবে কারণ স্বাধীন রাষ্ট্র ছাড়া আদি পুঁজির সঞ্চয় সম্ভব নয়।
স্বাধীন আধুনিক রাষ্ট্র তৈরি হয়েছিল ইউরোপে একটা নির্দিষ্ট ছকের মধ্য দিয়েঃ ছাপাখানা আবিস্কার, মুখের ভাষার প্রমিতকরণ, প্রোটেস্টান্ট আন্দোলন, পোপের গুরুত্ব কমিয়ে রাজার স্বনিযুক্তিকরণ, এক ভাষা এক ধর্মের রাষ্ট্র গড়ে ওঠা।
পঞ্চদশ শতকের মধ্য ভাগে গুটেনবার্গের ছাপাখানা বই ছাপার খরচ কমিয়ে দেয় আর এর ফলে মানুষের কাছে ছাপা বই সহজলভ্য হয়ে যায়। এর ফলে পড়াশুনা করে বই পড়া একটা নতুন ধরণের বিনোদন হয়ে ওঠে, অক্ষর জ্ঞান বিস্তার লাভ করতে থাকে, মুখের ভাষায় বয় ছাপা শুরু হয়, ফলে মুখের ভাষার প্রমিতকরণ (standardization)-এর প্রয়োজন দেখা দেয়, ইউরোপের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা (সাহিত্যের ভাষা) লাতিনের গুরুত্ব কমতে থাকে, বাইবেল-এর বহু মুখের ভাষায় অনুবাদ শুরু হয়, ফলে বাইবেল-এর ক্যাথোলিক চারচ-এর বাইরে স্বাধীন ব্যখ্যা বৃদ্ধি পায়।
ক্যাথোলিক চার্চ-এর অনুমোদন লাগতো ইউরোপের সমস্ত রাজার শাসক হিসেবে বৈধতা (Legitimacy) পেতে। ক্যাথোলিক চার্চ-এর পোপ রাজাকে অভিসিক্ত করত ঈশ্বরের অনুমদিত হিসেবে। আগে মানুষ ঈশ্বরে বিশ্বাস করত বেশি আর ঈশ্বরের মূল প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকার করত পোপকে আর তাই পোপের স্বীকৃতি ছাড়া ইউরোপের খ্রিশ্চান জনতা কাউকে রাজা হিসেবে মেনে নিত না। ইউরোপের রাজারা পোপের এই ক্ষমতাকে সবসময় খর্ব করতে চাইত। পোপ গ্রেগরি ও জার্মান সম্রাট হেনরির মধ্যে এই নিয়ে দীর্ঘ যুদ্ধ চলে একাদশ শতাব্দীতে। কিন্তু পোপের প্রচণ্ড ক্ষমতাকে অস্বীকার করার সাহস দেখাতে পারেনি ইউরোপের রাজারা। কিন্তু গুটেনবার্গের ছাপাখানার প্রভাব যত বাড়তে থাকে মানুষ শিক্ষিত হতে থাকে, স্বাধীন ভাবে বাইবেলের ব্যখ্যা বাড়তে থাকে, লাতিনের জায়গায় মুখের ভাষা জনপ্রিয় হতে থাকে ইউরোপের বহু রাজা এই সুযোগে পোপকে অমান্য করার সুযোগ পায়।
কেলভিন ও মারটিন লুথারের প্রোটেন্সটান্ট আন্দোলন পোপের ভিত দুর্বল করে দেয় আর সেই সুযোগে রাজা পোপের স্বীকৃতি ছাড়াই নিজেকে রাজা ঘোষণা করা শুরু করে। মুখের ভাষার প্রমিতকরণ ঘটান রাজা এবং বহু দেশে প্রোটেস্টান্ট ধর্ম গ্রহণ করে মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে রাজা। এইভাবে ভাষা ভিত্তিক জাতি রাষ্ট্র গড়ে ওঠে ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, পর্তুগাল ইত্যাদি দেশে ষোড়শ শতকেই। কিন্তু এই জাতি রাষ্ট্রগুলো গড়ে উঠেছিল অন্য ধর্মের মানুষকে উচ্ছেদ করে। প্রোটেস্টান্ট দেশগুলো বিতারিত করে ক্যাথোলিকদের আর ক্যাথোলিক রাষ্ট্রগুলো উচ্ছেদ করে দেয় প্রোটেস্টান্টদের। ভাষা প্রমিতকরণ করতে গিয়ে অজস্র মুখের ভাষাকে শেষ করে দেওয়া হয়। এইভাবে ইউরোপে গড়ে ওঠে এক ভাষী এক ধর্মের স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র। সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগে "ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধ" শেষ হলে ওয়েস্টফালিয়া চুক্তির মাধ্যমে ইউরোপে বৈধতা পায় রাজার স্বনিযুক্তিকরণ এবং এক ভাষী এক ধর্মের স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র।
এই জাতি রাষ্ট্রগুলোতে তিনটে বিষয় থাকা আবশ্যিক। নিজস্ব সামরিক বাহিনী, নিজস্ব প্রশাসন ও কাউকে ভাগ না দিয়ে কর তোলার ক্ষমতা এবং নিজস্ব মুদ্রা তৈরির ক্ষমতা। সামরিক বাহিনী দিয়েই সমাজের ভিন্ন ভাষা ও ধর্মের লোকেদের উচ্ছেদ করা হয় এবং অন্য কোন দেশ বা পোপকে খাজনার ভাগ না দেওয়াকে বৈধতা দেওয়া যায়। তাছাড়া অন্য ভাষা ও ধর্মের লোককে উচ্ছেদ করে তাদের সম্পত্তি দখলে নেওয়াও যায় যা আদি পুঁজি সঞ্চয়ের আরেকটা ভিত্তি হিসেবে কাজ করে পশ্চীম ইউরোপে। প্রাশিয়া নামের দেশ গোটা ইউরোপ থেকে ক্যাথলিক দ্বারা নির্যাতিত প্রটোস্টান্টদের আশ্রয় দিয়ে সপ্তদশ শতকে জনসংখ্যা বহু গুণ বাড়িয়ে নেয়। আবার কর তুলে তা নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা যায়। আর স্বাধীন মুদ্রার মাধ্যমে নিজের পুঁজিকে নিজের জাতি রাষ্ট্রের মধ্যে সঞ্চয় করা যায়। এছাড়াও ইউরোপের ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর জোড় ছাড়া এশিয়ার উন্নত শ্রম নিবিড় উৎপাদন ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করা সম্ভব হতনা। আর সামরিক বাহিনী নির্মাণে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ অনস্বীকার্য।
ইউরোপ এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকা জুড়ে উপনিবেশ বানিয়ে লুট করে বিপুল সোনা রূপো দখল করে যা ইউরোপের আদি পুঁজি সঞ্চয়ে আরেকটা বুনিয়াদ। ইউরোপ বিশেষ করে ইংল্যাণ্ড যেহেতু শিল্প বিপ্লবের সূচনা করেছে, সেই হেতু তাদের বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি কিনতে হয়নি বরং তা তারা নিজেরাই অনেক বেশি সময় নিয়ে তৈরি করার সুযোগ পেয়েছে। এই সুযোগটা রাশিয়া, এশিয়া, আফ্রিকা পায়নি কারণ তারা শিল্পায়ণ শুরু করেছে অনেক পরে।
এছাড়াও ইউরোপের আরেকটা আদি পুঁজির বুনিয়াদ হোল ভূমি সংস্কার যা নেপোলিয়নের সময় থেকেই শুরু হয়েছে। ইংল্যাণ্ডে চলেছে উলটো প্রক্রিয়া আর তা হোল জমিদারেরাই কৃষক উচ্ছেদ করে আস্তে আস্তে দুই-তিন শতক ধরে কৃষক প্রতি উৎপাদন বাড়িয়ে একটু একটু করে কৃষির শ্রম শক্তিকে শিল্পায়ণের জন্য কাজে লাগিয়েছে। ইংল্যাণ্ড এটা করতে পেরেছে শিল্পায়ণের সূচনাকারী হিসেবে কোন প্রতিযোগিতা না থাকায়। এই প্রক্রিয়ার ফলে আদি পুঁজির সঞ্চয় হয় ধীর গতিতে যার গুরুত্ব ফরাসী বিপ্লবের পর থেকেই কমে গেছে।
মনে রাখা দরকার ইংল্যাণ্ডের জমিদার শ্রেণী উলের চাষ ও ব্যবসা করতে কৃষক উচ্ছ্বেদ করে ভেড়ার চাষ শুরু করে ষোড়শ শতক থেকেই। এভাবে বড় পুঁজিপতি শ্রেণি তৈরি হয় ইংল্যাণ্ডে যারা ব্যক্তিমালিকানার ওপর দাঁড়িয়ে ইংল্যাণ্ডে শিল্পায়ণ করে। আবার ফ্রান্সে ভূমি সংস্কার কর্মসূচীর ফলে বড় পুঁজিপতি শ্রেণী ছিলনা আর তাই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে শিল্পায়ণ শুরু হয়। জার্মানিতে নেপোলিয়নের অধীনে থাকা পশ্চীম অংশতে ভূমি সংস্কার হয় আবার পূর্বে স্বাধীন থাকা প্রাশিয়াতে জমিদারি কায়েম থাকে এবং জমিদারই কৃষক উচ্ছ্বেদ করে। ফলে জার্মানিতে বড় পুজিপতিদের উদ্যোগ ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ দুইই বিদ্যমান ছিল। সোভিয়েতের ভূমি সংস্কার ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সমগ্র শিল্পায়ণ আসলে ফ্রান্সের শিল্পায়ণ কর্মসূচীরই উচ্চ রূপ।
স্বাধীন রাষ্ট্রের এই গুরুত্বের জন্যেই বিংশ শতকের মার্ক্সবাদী লেনিনবাদী ছকে লেনিন উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনকে ঢোকাতে বাধ্য হন এবং সোভিয়েত সংবিধানে সমস্ত রাজ্যগুলোকে ইচ্ছে হলে আলাদা রাষ্ট্র হওয়ার অধিকার দেওয়া হয়। বলাই বাহুল্য এই কারণেই ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এশিয়া ও আফ্রিকা জুড়ে স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র গড়ে তোলা ছিল মার্ক্সবাদী লেনিনবাদীদের প্রথম কাজ। স্বাধীন রাষ্ট্র পাওয়ার পরেই কেবল ভুমি সংস্কার, শিক্ষা স্বাস্থ্য পরিকাঠামোতে বিনিয়োগ এবং নারী মুক্তি সম্ভব।
এবার দেখা যাক একবিংশ শতাব্দীতে আদি পুঁজির সঞ্চয় কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। এই আলোচনা আমরা করব পর্ব ৩-এ।
Author: Saikat Bhattacharya