সুলতান ইলিয়াস শাহ

16-August-2023 by east is rising 198

ফেসবুক পেজ মুসলমানের স্বর্ণকাল থেকে নেওয়া 

সুলতান ইলিয়াস শাহর শাহ্-এর রাজত্বকালের একটি এক দিনার বাঙ্গালী স্বর্ণমোহরের মূল্যমান বর্তমানের হিসাবে দেড় লক্ষ টাকা। বাংলার অর্থনৈতিক উৎকর্ষের প্রমাণ আজও বিদ্যমান পর্তুগিজ ও চৈনিক পর্যটকদের লেখার পাতায় পাতায়।

পৃথিবীর সবচাইতে সুসমৃদ্ধ রাষ্ট্র ছিলো বাংলা, যার বণিকেরা পায়ে পরতেন সোনার কারুকার্যখচিত ভেড়ার চামড়ার জুতো।

ইলিয়াস শাহ্ ৭৩৮ হিজরি মোতাবেক ১৩৩৮ সালে রাঢ় ও বিহারের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং সাতগাঁও-এর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন ৷ কালক্রমে গড়ে তোলেন বিশাল এক সাম্রাজ্য, যার বিস্তৃতি নেপাল থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত! সকল বৈষম্য, আশরাফ-আতরাফ ভেদাভেদ, ব্রাহ্মণ-শূদ্র ভেদাভেদ উৎখাত করে ইলিয়াস শাহ্ বাঙালি জাতিকে ১৭৭ বছরের শোষণ (১১৬১-১৩৩৮) থেকে মুক্তিদান করেন। পাল সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে বাঙালি জাতি যে শোষণ ও নিপীড়নের শিকার হয়ে আসছিলো, তার অবসান ঘটে ইলিয়াস শাহর মসনদে আরোহণের মধ্য দিয়ে।

এর আগে বখতিয়ার খিলজীর গৌড় জয়ের মধ্য দিয়ে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে গৌড় একটা বড় সময় স্বাধীন ছিলো। কিন্তু হিন্দুস্তানের সুলতান যখনই স্বয়ং আক্রমণ করেছেন তখনই গৌড়ের স্বাধীনতার সমাপ্তি ঘটেছে! এর আগে সুলতান আলী মর্দান খিলজী (রাজত্ব: ১২১০-১২১৩), সুলতান ইয়াজ শাহ খিলজী (১২১৩-১২২৭), তুঘরিল তুঘ্রান খাঁ, বলকা খিলজী, সুলতান ইউজবেক শাহ (১২৫০-১২৫৮) এঁরা স্বাধীনই ছিলেন । আবার বলবানী বংশের সুলতানরা একটানা ১২৮৭ থেকে ১৩২৮ সাল পর্যন্ত শাসন ক্ষমতায় ছিলেন।

কিন্তু তারা কেউই বাংলা কে আঞ্চলিক পরাশক্তিতে পরিণত করতে পারেন নি৷

যখনই দিল্লীর সুলতান স্বয়ং আক্রমণ করেছেন বাংলার পতন ঘটেছে। তার কারণ- তাদের প্রতি জনগণের কোনো সমর্থন ছিলো না।

তারা ছিলো স্রেফ নিছক শাসক মাত্র, জনগণের অভিভাবক নয়। তাই তাঁরা বাংলা শাসন করা বা দিল্লীর সুলতানের বাংলা শাসন করা- জনগণের কাছ দুটোই একই জিনিস ছিলো! তাঁরা ব্যর্থ কেননা- জনগণ কে তাঁরা ইনসাফ দিতে পারেন নি। সেসময় আশরাফ-আতরাফ ভেদাভেদ ছিলো। অর্থাৎ, ধর্মান্তরিত মুসলিমদের উপর জন্মগত তুর্কি মুসলমানদের বৈষম্যের দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো। তুর্কীরা ধর্মান্তরিত বাঙালি মুসলিম দের মুসলিম বলে গণ্যই করতো না, কোনো সরকারি চাকরিতে তাদের অধিকার ছিলো না- ব্যাপারটা অনেকটা উমাইয়াদের অনারব দের থেকে জিজিয়া নেবার মতো জঘন্য! ইসলাম গ্রহণ করার পরেও বাঙালিদের সাথে কাফিরের মতো আচরণ করা হতো।

[ এই নিকৃষ্ট জাতপ্রথা ইসলাম সমর্থন করে? ]

আর অমুসলিমদেরও সরকারি চাকরির কোনো অধিকারই ছিলো না। ধর্মান্তরিত মুসলিমদেরই যেখানে অধিকার দেয়া হচ্ছে না, সেখানে অমুসলিমদের তো প্রশ্নই আসে না!

আর এইজন্যেই তাদের প্রতি জনগণের কোনো সমর্থন ছিলো না।

কারণ আপনি শাসক হয়ে প্রজাদের মধ্যে বৈষম্য করছেন - তারা তো আপনার জন্য মনপ্রাণ দিয়ে জীবন বাজি রাখবে না! আপনি যে জন্মগত মুসলিম তাকেই শুধু সুবিধা দিচ্ছেন, যে ধর্মান্তরিত তাকে যোগ্যতা থাকার পরেও সুবিধা দিচ্ছেন না। আপনার অমুসলিম প্রজাদের আপনি অধিকার দিচ্ছেন না। তাহলে

তারা তো আপনার জন্য মনপ্রাণ দিয়ে লড়বে না!

আর এজন্যই গৌড় সালতানাতের সুলতানরা বেশিদিন শাসন করতে পারেন নি। তাঁদের কোনো ধরনের জনসমর্থনই ছিলো না। তাঁরা প্রজাদের হৃদয় জয় করতে পারেন নি....

বিজয় অর্জন করতে গেলে সবার আগে প্রজার মন জয় করতে হয়। প্রজাপালক না হলে শাসক হওয়া যায়, অভিভাবক হওয়া যায় না।

ইলিয়াস শাহ্ হলেন সর্বপ্রথম শাসক যিনি প্রজার মন জয় করেছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম শাসক যিনি জাতির অভিভাবক হয়ে উঠেছিলেন। বাংলার অন্যান্য সুলতানরা অনেকেই বাংলার অধিপতি হয়েছিলেন, তবে ইলিয়াস শাহ হয়েছিলেন বাংলার মানুষের হৃদয়ের সম্রাট।

স্বীয় কর্মগুণে তিনি জয় করেছিলেন হিন্দু-মুসলিম সবার হৃদয়।

যিনি ধর্ম-বর্ণ-আশরাফ-আতরাফ সকল ভেদাভেদ চূর্ণ করেছিলেন। তাঁর সুশাসনে ধর্মান্তরিত মুসলিম তো বটেই, যোগ্য হিন্দুরাও উচ্চ রাজপদে অধিষ্ঠিত হতে পারতেন। বিচক্ষণ ইলিয়াস শাহ হিন্দুদের নেতৃত্ব দিতেন মুসলমানদের হাতে, মুসলমানদের নেতৃত্ব দিতেন হিন্দুদের হাতে- যাতে তাঁরা একসাথে ষড়যন্ত্র করতে না পারে।

ইলিয়াস শাহ একজন পার্শিয়ান সিস্তানি হয়ে বাংলাকে ভালবেসে বাঙালি হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি নিজেকে বলতেন- 'আমিই বাঙলা', তাই নামের শেষেই 'বাঙ্গালাহ' উপাধিটি যুক্ত হয়ে যায়- 'শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ বাঙ্গালাহ্'।

ইলিয়াস শাহর পূর্বে বাংলার সাথে দিল্লীর যত যুদ্ধ হতো, তা ছিল মূলত গৌড়ের তুর্কি মুসলিমের সাথে দিল্লীর তুর্কি মুসলিমের লড়াই। লড়াই হতো তুর্কিতে তুর্কিতে, রাজায় রাজায় -- সাধারণ জনগণের কোনো মাথাব্যথা ছিলো না।

ইলিয়াস শাহ্ সর্বপ্রথম বাংলার সাথে হিন্দুস্তানের যুদ্ধকে একটি "'জাতীয় রূপ" প্রদান করেন।

আমি বাংলার অধিপতি, বাঙালিদের বাদশাহ, আমার সাথে আমার লোকেরা আছে -- যে জন্মগত মুসলিম সেও আছে, যে ধর্মান্তরিত মুসলিম সেও আছে, আমার যে প্রজা অমুসলিম সেও আছে!

তুমি হিন্দুস্তানের রাজা, তোমার সাথে তোমার লোকরা আছে...!!

এভাবেই ইলিয়াস শাহ সর্বপ্রথম হিন্দুস্তান-বাংলার লড়াইকে জাতীয় রূপ দিলেন।

আর এজন্যই ইলিয়াস শাহ্ বাঙ্গালী জাতির জনক।

আর এজন্যই একডালার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে হাজার হাজার পাইকসেনা প্রাণ দিয়েছিলো, লাশের পর লাশ পড়েছিলো- তবুও বাঙালিরা থামেন নি। আর এই জন্যেইই, বাংলা সালতানাত সুদীর্ঘ আড়াইশ বছর রাজত্ব করেছিলো - গৌড় সালতানাতের পক্ষে সাতান্ন বছরের বেশি স্থায়ী হয় নি!

আর তাই, ইলিয়াস শাহ্ অন্য অপরাপর সুলতানদের মতো হলেও তিনি অসাধারণ... অনেকের মাঝে একজন হলেও তিনিই শ্রেষ্ঠ...

বাংলার মুক্তির সাল ১৩৩৮, যখন ইলিয়াস শাহ স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। যার শাসনামলে বাংলা এতো ধনী ছিলো যে, তাঁর একটি স্বর্ণমুদ্রার মূল্য বর্তমানের প্রায় দেড় লাখ টাকা।

মুদ্রায় লিখিত আছেঃ

............ "সিকান্দার-ই-সানী ইয়ামিন আল-খিলাফাহ আমীর উল-মুমিনীন সুলতান উল-আদিল শামসউদ্দিন আবুল মুজাফফর ইলিয়াস শাহ আস-সুলতান" [ কমেন্ট সেকশনে ]

চিত্রঃ বিস্তৃতির শিখরে বাংলা সালতানাত ১৩৯৪-১৩৯৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে, গিয়াসউদ্দিন আজম শাহর শাসনামলে, আয়তন- ১৪,৬৮,৭০৬ বর্গকিলোমিটার

Author: Saikat Bhattacharya


You may also like