
ফিলিস্তিনিরা লড়াই করছে স্বাধীনতার জন্য নাকি নিজ দেশে দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ!
করছে এটি জানতে হবে।
১ম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৮) আগ পর্যন্ত 'স্বাধীন' ফিলিস্তিন ওতমানিয়া সাম্রাজ্যের অধীনে ভালোই চলছিল। যুদ্ধ চলাকালীন আরবরা (মিশর ইউরদান সিরিয়া ফিলিস্তিন) তুর্কি (ওতমানিয়া শাসকদের) শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। ১৯১৮'র শেষ দিকে ওতমানিয়াদের পরাজিত করে ফিলিস্তিন তথা আরব ছাড়া করে।
১ম বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী ফ্রন্ট/ দেশগুলো ১০ জানুয়ারি ১৯২০ সালে 'লিগ অব নেশন' নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলে। (১৯৪৬ সালে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হলে সেটা বিলুপ্ত হয়ে যায়) এই সংগঠন/সংস্থার মাতব্বরি থাকে বৃটিশদের হাতে। ফিলিস্তিন অঞ্চল তখন ফাঁকা মাঠ! আর এখানেই চোখ পরে ব্রিটিশদের।
নিজেদের গড়া লিগ অব নেশন থেকে তারা একটি সিদ্ধান্ত নেয় যে- সাবেক ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের আরব অঞ্চলের শাসন ক্ষমতা ব্রিটিশদের হাতে দেওয়া হোক। নিজেরাই নিজেদের দায়িত্ব দেয়! আরবরা উল্লসিত হয়ে উঠে, আনন্দে আত্মহারা হয়ে ব্রিটিশদের 'স্বাগত' জানায়।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলে রাখা দরকার, সেটা হলো- ১ম বিশ্বযুদ্ধ যখন চলছিল তখন অর্থাৎ ১৯১৭ সালে 'বেলফোর ডিকলারেশন' বা বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ব্রিটিশরা ইউরোপের ছন্নছাড়া ইহুদিদের জন্য একটি স্থায়ী বসতিস্থল তৈরি করে দেওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। এজন্য তারা প্রথম পছন্দ হিসেবে আর্জেন্টিনাকে বেছে নেয় এবং দ্বিতীয় পছন্দ রাখে উগান্ডাকে।
বর্তমান মিশর ইউরদান ফিলিস্তিন ও সিরিয়া অঞ্চলে ইহুদিরা প্রাচীনকাল থেকে বসবাস করে আসছিল, যদিও তারা সংখ্যায় ছিল খুবই কম।
আজ থেকে প্রায় চার/সাড়ে চার হাজার বছর পূর্বে বনি ইসরাইল জাতি (আজকের ইহুদিদের পূর্বপুরুষরা) ফেরাউনের শাস্তি পেয়ে যখন মিশর থেকে পালায় এবং আমালেকা জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ভয় পেয়ে অস্বীকৃতি জানায় তারপর থেকেই ইহুদিরা ভাসমান জাতি হিসেবে পালিয়ে বেড়াতে থাকে।
কালের পরিক্রমায় সামান্য কিছু অংশ ফিলিস্তিনে বসতিগাড়লেও বাকিরা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি ভারতবর্ষের কলিকাতায় পর্যন্ত ইহুদিরা বসবাস শুরু করে।
সেই থেকে ফিলিস্তিন অঞ্চলে ইহুদিরা মুসলমান ও খৃষ্টানদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে আসছিল। সেসময় মুসলমানদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৭৫%, খৃষ্টান ২০% ও বাকিরা ইহুদি জরাথ্রুস্ট ইয়াজেদি ইত্যাদি।
১৯৪৫ সালে ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপের ইহুদিরা নানান কারণে নিগৃহীত হতে থাকে, মূলত তাদের কুটিল স্বভাবের কারণে। হিটলার ইহুদিদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নেয় এবং ইহুদিদেরকে নিকৃষ্ট জাতি ঝগড়াটে জাতি আখ্যা দিয়ে জার্মানিকে ইহুদিমুক্ত করার অভিযান শুরু করে।
তখন বাস্তুচ্যুত ইহুদিদের জন্য দু-হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসে বৃটেন ও আমেরিকা। তারা তড়িঘড়ি করে ইহুদিদের জন্য একটি আশ্রয়স্থল খুঁজতে থাকে। এবং খুঁজে পায় ফিলিস্তিনকে। যুক্তি হলো ফিলিস্তিনের ইহুদিরা সবচেয়ে নিরাপদে আছে এবং সংখ্যালঘু হয়েও শান্তিতে আছে, সুতরাং স্বল্প সময়ের মধ্যে এসব ইহুদি শরণার্থীদের জন্য আপতত নিরাপদ স্থান হবে কাছের ফিলিস্তিন।
ফিলিস্তিন প্রশাসনের সাথে আলোচনা করা হলো। ফিলিস্তিনি আরবরা উদার মনে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে আশ্রয় দিতে রাজি হয়ে গেল এবং বললো 'ইহুদিরা তো আমাদের ভাইয়ের মতো'। তারা ইহুদিদের স্বাগত জানাল। স্থানীয় ইহুদিরাও খুশি মনে তাদেরকে গ্রহণ করে নিল। তাদের জন্য অস্থায়ী ক্যাম্প বানানো হল।
১৯৪৬ সাল, এক চুক্তির মাধ্যমে আরবের ক্ষমতা আরবদের হাতে দিয়ে বৃটিশরা আরব অঞ্চল ছেড়ে গেল। তবে মাতুব্বরি ধরে রাখল।
১৯৪৭ সাল। ফিলিস্তিনে শরণার্থী হিসেবে আসা ইহুদিদের সংখ্যা আরো বাড়ল, তাদের আলাদা একটা গ্রাম হয়ে গেল। সংখ্যা আরো বাড়ল। এবার ফিলিস্তিন সরকারের কাছে তারা স্কুল বাজার হাসপাতাল খেলার মাঠ উপাসনালয় ইত্যাদি বানানোর জন্য জমি চাইল। তাদেরকে তা দেওয়া হলো।
ইসরাইলিদের জাতির পিতা ডেভিড বেলগুরিয়ানের প্রমিজ ল্যান্ড বা ইহুদিদের স্বপ্নভূমি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন তারা দিবানিশি দেখতে লাগল। তাদের স্বপ্ন তারা মিশরের সিনাই ইউরদান সৌদি আরব ফিলিস্তিন সিরিয়া হয়ে কুয়েত পর্যন্ত ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে, এটাই হলো তাদের স্বপ্ন। এটাই তাদের প্রমিজ ল্যান্ড।
ইহুদিরা সংখ্যায় দ্রুত বাড়তে লাগল এবং তারা এখানেই তাদের বসতি স্থাপনের সহায়তা চাইল, আর্জেন্টিনা এবং উগান্ডা বাদ। বৃটিশরা বললো, ভেরি গুড ডিসিশন! তারা সেই বেলফোর ঘোষণার আলোকে এগিয়ে আসল।
১৯৪৮ সাল। ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনি ও ইহুদিদের সাথে আলোচনা করে ফিলিস্তিনের উত্তর দিকের ১৭% জায়গা জুড়ে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নিল।
আরবরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। বৃটিশ বিরোধী প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু হল, ফিলিস্তিনিদের কথা হলো- আমাদের নিজ দেশের ভিতরে আরেক দেশের জন্ম আমরা মানিনা.... এটা হতে পারেনা।
আবার ঐ দিকে ইহুদিরাও এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন করল, তাদের দাবী- মাত্র ১৭% জায়গা নিয়ে এতো ছোট রাষ্ট্র আমরা মানিনা। আমাদের জন্য ফিলিস্তিনের কমপক্ষে ৫০% জায়গা চাই! রাষ্ট্র গঠন হয়ে গেল- নাম দেয়া হলো ইসরাইল। আমেরিকা ও বৃটেন সাথে সাথে স্বীকৃতি দিল। (মাসুদ আলম)
অবৈধ ইসরাইল সরকার ঘোষণা দিল- পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের জন্মসূত্রে ইহুদি নাগরিককে ইসরাইলে স্বাগতম। অর্থাৎ এদেশে আসলেই তাকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে।
এই ডাকে সাড়া দিয়ে সারা পৃথিবীর ধনি জ্ঞানী গুণি শিক্ষিত সবাই আসতে লাগল। নতুন জাতি নতুন দেশ গঠনের শপথ নিয়ে কাজ করা শুরু করল।
আমেরিকা থেকে আলবার্ট আইনস্টাইন আসল, কলিকাতা থেকো বাংলাভাষী ইহুদিরা গেল ইত্যাদি।
আমেরিকা বৃটেন ফ্রান্স কানাডা সহ পৃথিবীর ধনী দেশগুলো নতুন রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক সামরিক প্রযুক্তিগত ইত্যাদি নানান ভাবে সাহায্য করতে থাকল। নতুন রাষ্ট্র গঠন করেই তারা ফিলিস্তিনিদের উপর চড়াও হল, জমিজমা দখল করা শুরু করল। কোন প্রকার অনুমতি না নিয়ে আরবদের জমিতে ভবন স্থাপনা নির্মাণ শুরু করল।
আরবরা ক্ষিপ্ত হয়ে ১৫ মে ১৯৪৮ তারিখে ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। আমেরিকা বৃটেন ফ্রান্স কানাডা সহ অনেক দেশ ইসরাইলের পক্ষে সরাসরি সাহায্য করল। ১০ মে ১৯৪৯, আরবরা পরাজিত হল।
১৯৫৬ সাল। মিশরের প্রসিডেন্ট জামাল আব্দুল নাসের
ঘোষণা দিল যে, সুয়েজ খাল আজ থেকে মিশরের জাতীয় সম্পদ। এতে মিশরের একচ্ছত্র আধিপত্য এবং কর্তৃত্ব। (অর্থাৎ বিদেশি জাহাজ পারাপার হতে চাইলে টোল দিতে হবে।) এতে ক্ষুব্ধ হয় বৃটেন এবং ফ্রান্স।
তারা ইসরাইলকে দিয়ে মিশর আক্রমণ করায়। এই যুদ্ধে মিশরের ১৬৫০ জন সৈন্য নিহত হয় এবং ১০০০ জন সাধারণ মানুষ নিহত হয়। অপর দিকে ইসরাইলের ১৭২ জন, বৃটেনের ২২ ও ফ্রান্সের ১০ জন সৈন্য নিহত হয়। পরে আমেরিকার হস্তক্ষেপে যুদ্ধের অবসান হয়। সুয়েজ ক্যানেলে মিশরের কর্তৃত্ব বজায় থাকে।
লেখক সৈকত ভট্টাচার্য এর সাথে যুক্ত করছে যে- ১৯৫৬-তে মিশরের সেনা বাহিনী পরাজিত হলে সোভিয়েত ইউনিয়ন বলে তারা ইস্রাইল ফ্রান্স ও ব্রিটেনের বিরুদ্ধে পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করবে যদি না তারা মিশর থেকে সরে না আসে। এই অবস্থায় মার্কিন সরকার বলে সোভিয়েত মিশরে সেনা পাঠাতে পারে ভেবে বাধ্য হয় ইস্রাইল ফ্রান্স ও ব্রিটেনের বিরুদ্ধে আর্থিক অবরোধ করতে।
১৯৬৭ সালে আরবরা আবারো ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। মাত্র ৬ দিনের যুদ্ধে আরবরা শোচনীয় ভাবে পরাজিত হল। মিশরের সিনাই উপত্যকা, ইউরদানের বিশাল অঞ্চল, ফিলিস্তিনের প্রায় ৭০%, সিরিয়ার বিশাল অংশ দখল করে নিল দখলদার ইসরাইল।
মিশর এবং ইউরদান বললো- আমাদের অঞ্চল ফিরিয়ে দিলে আমরা তোমার দখলকৃত অংশসহ ইসরাইল নামক রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিবো।
দখলদার ইসরাইল খুব খুশি হলো। প্রথম আরব দেশ হিসেবে মিশর দখলদার ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিল, তারপর ইউরদান স্বীকৃতি দিল। সিরিয়া ও ফিলিস্তিন স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানাল এবং দখলদার রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার ঘোষণা দিল।
১৯৭১ সালে সিরিয়ার হাফেজ আল আসাদের সরকার সোভিয়েত ইউনিয়নকে টারটুস-এ সামরিক নৌ ঘাটি খোলার অনুমোদন দেয়।
১৯৭৩ সালের অক্টোবরে মিশর ও সিরিয়া আবারো দখলদার ইসরাইল আক্রমণ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের পাঠানো সামরিক সরঞ্জামের সাহায্যে। ১৯ দিনের এই যুদ্ধে আবারও আরবরা পরাজিত হয় এবং দখলদার ইসরাইল পুনরায় সিনাই উপত্যকার দুই তৃতীয়াংশ দখল করে নেয়। আবারও সোভিয়েত ইউনিয়ন ইস্রাইলের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ করার হুমকি দেয় এবং মার্কিন সরকার নামে সোভিয়েতের মধ্যপ্রাচ্যে আসা আটকাতে। ফলে আমেরিকার মধ্যস্থতায় যুদ্ধ বন্ধ হয়। কিন্তু সিরিয়া যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। এই যুদ্ধ ইয়াম কিপুরের যুদ্ধ / রমাদান ওয়ার নামে পরিচিত।
তারপর থেকে প্রতিদিনই দখলদার ইসরাইল একটু একটু করে ফিলিস্তিনের জমি দখল করে যাচ্ছে। বর্তমানে ফিলিস্তিনের প্রায় ৮০% দখল করে ফেলেছে ইসরাইল।
আর ফিলিস্তিনিরা বাঁধা দিতে গিয়ে মরছে!
লিখেছেন Sakil Rony
Author: Saikat Bhattacharya