আধুনিকতাবাদের জন্মের পেছনে ইসলামের গুরুত্ব


আধুনিক ইউরোপের জন্মের পেছনে কারণগুলো ঠিক কি কি তা জানতে গেলে আধুনিক ইউরোপ জন্মের সময়টা বুঝতে হবে এবং তার আগের শতকগুলোতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো জানতে হবে।

এমনিতে আধুনিক ইউরোপের জন্ম পঞ্চদশ শতকের মধ্যভাগেই ধরা হয়। দুটো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার মধ্যে দিয়ে আধুনিক ইউরোপের জন্ম হয়। এক, ১৪৫৪ সালে জার্মানিতে গুটেনবার্গের ছাপাখানা আবিস্কার আর দুই, ১৪৫৩ সালে ওটোমান তুর্কিদের দ্বারা কন্সতান্তিনোপল অধিকৃত হওয়ায় প্রচুর গ্রীক প্রাচীন গ্রীক ও রোম-এর জ্ঞান নিয়ে ইতালিতে এসে থাকা শুরু করে।

ছাপাখানা আবিস্কারের ফলে বই তৈরি করার খরচ কমে যায় এবং বই হয়ে ওঠে সহজলোভ্য ও সস্তা। ফলে প্রচুর ইউরোপীয় বাইবেল নিজের মতো করে লিখতে ও পড়তে শুরু করে। আর এর ফলে স্থানীয় মুখের ভাষার বিকাস হয়, লেখার ভাষা হিসেবে লাতিনের গুরুত্ব কমে, ক্যাথোলিক চার্চের মতো করে বাইবেল পড়ার বিরোধিতা শুরু হয়। ফলে প্রতেন্সতান্ত আন্দোলন শুরু হয়, রাজারা পোপের গুরুত্ব কমাতে বহু দেশে প্রতেস্তান্ত আন্দোলনকে সাহায্য করা শুরু করে ও লাতিনের গুরত্ব কমাতে স্থানীয় ভাষার প্রমিতকরণ শুরু করে। এভাবেই গড়ে ওঠে ভাষাকে ভিত্তি করে জাতি রাষ্ট্র।

কন্সতান্তিনোপল থেকে আগত গ্রীকরা ইউরোপীয়দের প্রাচীন গ্রীক ও রোমের জ্ঞান দান করে এবং এর ফলে ধর্মের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস ত্যাগ করে যুক্তির ওপর নির্ভরশীল হতে শেখে ইউরোপীয়রা আর এভাবেই আধুনিকতার জন্ম।

কিন্তু এই গল্প যথেষ্ট যুক্তি সম্মত নয়। এক, কেন হঠাৎ ছাপাখানার মতো কিছুর আবিস্কারের দরকার পড়ল। কোন প্রয়োজন ছাড়া কি এরকম আবিস্কার হয়? দুই কন্সতান্তিনোপল থেকে আগত গ্রীকরা ইউরোপীয়দের প্রাচীন গ্রীক ও রোমের জ্ঞান দান করে ইউরোপে আধুনিকতা নিয়ে আনতে পারে তবে কন্সতান্তিনোপল-এ আগেই কেন আধুনিকতার জন্ম হয়নি?

মজার ব্যাপার হল প্লেটো আরিস্টোটল টোলেমির মতো গ্রীক দার্শনিকের লেখা ত্রয়োদশ শতকের মধ্যেই বহুবার লাতিনে অনুদিত হয়ে যায়। ১৪৫৩ সালের অনেক আগেই যখন গ্রীকরা ইতালীতে আসে। এবার প্রশ্ন কোন ভাষা থেকে লাতিনে অনুদিত হয়? উত্তর হোল আরবি ও ফার্সি। এবার প্রশ্ন জাগে কিভাবে আর কেন প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকদের লেখা আরবি ও ফার্সিতে অনুদিত হল?

এর উত্তর পেতে গেলে চলে যেতে হবে সপ্তম শতকের মধ্য ভাগে। অর্থাৎ গুটেনবার্গের ৮০০ বছর আগের ইতিহাসে। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে আরবরা তখন দুর্বার গতিতে গ্রীক অঞ্চল (রুম সাম্রাজ্য), পার্সি অঞ্চল, মধ্য এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা দখল করছে। তখন বই তৈরি করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ছিল আর তাই অধিকাংশ মানুষই ধর্ম গ্রন্থ মুখস্থ করত। আরবরাও প্রথমে কোরান মুখস্থ করেই চলত। কিন্তু খলিফারা দেখল এর ফলে কোরানের কথা বিকৃতির সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। তাই খলিফারা কোরানের লিখিত রূপ তৈরির দিকে যথা সম্ভব মন দেন। শুরু হোল কোরান-এর অজস্র অনুলিপি তৈরির কর্মসূচী। ছাপাখানা তখন ছিলনা বলে প্রচুর লেখক নিয়োগ করা হয় কোরানের অনুলিপি তৈরির জন্যে সরাসরি খলিফাদের তত্ত্বাবধানে। কিন্তু এই বিপুল লেখক নিয়োগ ক্রমেই খলিফাদের সাহায্য করল প্রাচীন গ্রীক রোম পার্সি জম্মুদ্বীপ (ভারত) ও চীন-এর জ্ঞানকে আরবি ও ফার্সিতে অনুদিত করতে। অষ্টম শতকের শেষ ভাগ থেকেই খলিফাদের তত্ত্বাবধানে প্রাচীন সংস্কৃত গ্রীক রোমান ফার্সি চীনা বই সংগ্রহ শুরু হয়ে যায়।

খালিফাদের তত্ত্বাবধানে আরবি পার্সি বারবার মধ্য এশীয় লেখকেরা কেবল সেই সব প্রাচীন বই অনুদিতই করেনি বরং তাতে নিজস্ব ভাবনাচিন্তা যুক্ত করেছে এবং প্রয়োজনে প্রাচীন বইকে সংশোধন করে নতুন বই লিখেছে। যেমন ব্রক্ষগুপ্তের "সিদ্ধান্ত" বইটিকে আরবি ভাষায় অনুদিত করে লেখা হয় "সিন্দ হিন্দ" আর তা থেকেই আরবরা ০ থেকে ৯ দশমিক সংখ্যা তৈরি করে এবং আরবদের থেকেই এই জ্ঞান ইউরোপে পৌছয়। আল খোয়ারজাম "আল জেবর" বলে একটা বই লেখেন যা বিশ্বে আলজেব্রা সম্পর্কিত প্রথম বই। আল হায়থাম আলোর চলাচল নিয়ে বই লেখেন যা নিউটন তার রেফারেন্সে গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেন। ইবনে সিনা লেখেন চিকিৎসা বিষয়ক বই যার ইংরেজি নাম "ক্যানন অফ মেডিসিন" যা সপ্তদশ শতক পর্যন্ত ইউরোপীয়দের চিকিৎসা সম্পর্কে ব্যবহার করা প্রথম বই। যে ডারউইনের বিবর্তনবাদ নিয়ে আধুনিকতার এতো গর্ব তারও আদী বই হল আল জাহিজ লিখিত "কিতাব আল হায়োয়ান" যেখানে এক জীব আর এক জীবে পরিণত হয় স্পষ্টভাবে বলা হয়। আল জাজরি স্বয়ংক্রিয় মেশিন নিয়ে বই লেখেন। ইবনে খাদলুন লেখেন ইতিহাস নিয়ে বই এবং সেখানে যেভাবে নদীর পাশে গড়ে ওঠা প্রথম সভ্যতা নিয়ে পড়ানো হয় আজও পৃথিবীর সমস্ত আধুনিক স্কুলে সেভাবেই ইতিহাস পড়ানো হয়।

এবার কেউ বলতেই পারেন এই সমস্ত মুসলমান লেখকেরা আদৌ ইসলাম মেনে চলতো কি না? এনাদের অনেকেই নবীর অনেক সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন যেমন আল বেরুনি সৌর বছরের পক্ষে কথা বলেন এবং চান্দ্র বছর মেনে চলাকে নবীর ভুল সিদ্ধান্ত বলেন। তবে এই জ্ঞানীদের অধিকাংশই ইসলামের বিশেষ সেক্ট মুতাজিলা মতবাদে মেনে চলত। মুতাজিলা মতবাদ নবম শতকের শুরু থেকে একাদশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত বেশ সক্রিয় ছিল। খলিফা আল মামুনের সময় ৮৩৩-৮৫১ মুতাজিলা সরকারী মতবাদ ছিল। খলিফা দ্বিতীয় আল হাকাম-এর সময় ৯৬১-৯৭৬ মুতাজিলা ও অনুবাদ আন্দোলন মিলেমিশে গেছিল।

সেলজুক তুর্কিদের আগমণ এবং ক্রুশেডের যুদ্ধ ক্রমেই জ্ঞান চর্চাকে করে তোলে আরবদের কাছে আলোস্য। ক্রুশেডের যুদ্ধের সময়েই ইউরোপীয়রা প্রথম মুসলমানদের উন্নত জ্ঞান সম্পর্কে জানতে পারে এবং তারা আরবি ভাষা থেকে লাতিন ভাষায় অনুবাদ করার কাজ শুরু করে ত্রয়োদশ শতক থেকেই। সালাদিনের কাছে জেরুজালেমে পরাজিত হয়ে ক্রুশেডারেরা এই সিদ্ধান্তে উপনিত হয় যে আরব পার্সি-দের জ্ঞান চর্চা ও বাণিজ্য বিদ্যা ও তুর্কিদের যুদ্ধ কৌশলের কাছে তাদের হার হয়েছে। ক্রুসেডারেরা দুর্বল হলেও মোঙ্গল আঘাতে জর্জরিত হওয়ায় আরব পার্সিরা ত্রয়োদশ শতক ও চতুর্দশ শতকে সেভাবে জ্ঞান চর্চা করতে ব্যর্থ হয়। ইউরোপীয়রা ওই দুই শতকে নিজেদের জ্ঞান চর্চার ভিত্তি শক্তপোক্ত করে। যার পরিণতিতে পঞ্চদশ শতকের মধ্যভাগে এসে ছাপাখানা আবিস্কার ও প্রাচীন গ্রীক রোমের জ্ঞান চর্চা করতে পারার মতো অবস্থায় যায় ইউরোপ। হয়তো বই অনুবাদ করার ও বই পড়ার চাহিদা বাড়ছিল বলেই ছাপাখানার আবিস্কার হয়। 

Author: Saikat Bhattacharya


You may also like