রাষ্ট্র কি?


রাষ্ট্র প্রধানত হল কর সংগ্রাহক এবং কর হল এক ধরণের জোরপূর্বক অর্থ হস্তান্তর। তাই এটি উদ্বৃত্ত শ্রম আহরণের সাথে যুক্ত। এখন প্রশ্ন আসে কোন জোরে এই টাকা হস্তান্তর করা হয়। উত্তর সশস্ত্র দলের শক্তি দ্বারা। তাই যাদের কাছ থেকে কর নেওয়া হয় তাদের চেয়ে অন্তত বেশি সশস্ত্র লোকদের মাধ্যমে অর্থ হস্তান্তর কার্যকর করা হয়।   

এখন ওপরে উক্ত কর সংগ্রহ করা রাষ্ট্র যদি অন্য কর সংগ্রহ করা রাষ্ট্র-এর মুখোমুখি হয়? তিনটি সম্ভাব্য ফলাফল হবে। এক রাষ্ট্রের বাহিনী অন্যটির চেয়ে বেশি শক্তিশালি হবে এবং জয়ী হবে। বিজয়ী রাষ্ট্র প্রতিপক্ষ রাষ্ট্রকে ধ্বংস করবে এবং তার কর সংগ্রহের জায়গাগুলো দখল করবে অথবা বিজয়ী রাষ্ট্র পরাজিত রাষ্ট্রের কর রাজস্বের একটি ভগ্নাংশ আহরণ করবে। আরেকটি সম্ভাব্য ফলাফল উভয়ই তাদের নিজস্ব কর সংগ্রহের জায়গাগুলোর পুরোটা বা কিছুটা ধরে রাখতে সক্ষম হবে আর এর ফলে দুটো টিকে থাকবে।  

সুতরাং একটি রাষ্ট্র তার শাসনাধীন জনগণকে কর দিতে বাধ্য করতে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র-এর থেকে নিজেকে ও নিজের আয়কে রক্ষা করার জন্য সশস্ত্র দল রাখবে। প্রথম দায়িত্বটি পুলিশ এবং আমলা দ্বারা পরিচালিত হয় এবং পরবর্তী দায়িত্বটি সেনাবাহিনী এবং গোয়েন্দাদের দ্বারা সঞ্চালিত হয়।  

সুতরাং অন্য রাষ্ট্র থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য রাষ্ট্রের সামরিক ও গোয়েন্দা বিভাগ প্রয়োজন এবং তার কর্তৃত্বের অধীনে বসবাসকারী জনগণকে কর প্রদানে বাধ্য করার জন্য পুলিশ ও আমলাতন্ত্রের প্রয়োজন। এটি সমস্ত রাষ্ট্রের ভিত্তি। 

সমগ্র সমাজের উপর তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করার পর, রাষ্ট্র ধীরে ধীরে কিছু মৌলিক সেবা প্রদান করবে যাতে তার শাসন করা সমাজ থেকে শাসন করার বৈধতা অর্জন করা যায়। এই মৌলিক পরিষেবাগুলির মধ্যে সর্বাগ্রে হল বিচার বিভাগ। বিচার বিভাগ রাষ্ট্রকে সমাজের বিভিন্ন দ্বন্দ্বরত ব্যক্তির মধ্যে শান্তিপূর্ণ ভাবে বোঝাপোড়া করায়। জনগণ বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ধীরে ধীরে শাসক রাষ্ট্রের কাছে যেতে শুরু করে। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার, বাজারের নিয়ম, শান্তি ও সমৃদ্ধি বজায় রাখার ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের কাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই বিচার বিভাগ রাষ্ট্রকে সাধারণ মানুষের জন্য অপরিহার্য করে তোলে। সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য রাষ্ট্রের জোরপূর্বক কর আদায় জরুরি বলে মনে করতে শুরু করে সাধারণ মানুষ।  

বিচারব্যবস্থা ছাড়াও, রাষ্ট্র রাস্তা, সেতু, খাল, হাসপাতাল, স্কুল, গরীবদের ডোল প্রদান ইত্যাদির মতো পরিষেবাও দিতে পারে। যদিও এই পরিষেবাগুলি একটি রাষ্ট্রকে তার জনগণের দৃষ্টিতে বৈধ করে, তবে সেগুলি খুব ব্যয়বহুল প্রমাণিত হতে পারে। সাধারণভাবে আমরা দেখি যে উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রযুক্তির উন্নতি হয়, কর রাজস্ব বৃদ্ধি পায় এবং তাই রাষ্ট্র আরও এই ধরনের পরিষেবা দিতে পারে। তদুপরি, আজকের উন্নত অর্থনীতিগুলি অতি উৎপাদন সংকটের মুখোমুখি হয় যেখানে যোগান চাহিদাকে ছাড়িয়ে যায় এবং তাই এই মৌলিক পরিষেবাগুলিতে রাষ্ট্রের ব্যয় চাহিদা সৃষ্টির প্রধান উৎস হয়ে ওঠে যা উৎপাদনের পূর্ণ বিকাসে সহায়তা করে। আবার বর্তমান উন্নয়নশীল রাষ্ট্রেও শিক্ষা স্বাস্থ্য পরিকাঠামো নির্মাণ মানুষের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করে এবং উৎপাদন বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। উৎপাদন বৃদ্ধি হলে রাষ্ট্রের কর জাত আয়ও বৃদ্ধি পাবে। তাই আমরা এই উপসংহারে পৌঁছাতে পারি যে প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং রাজস্ব বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে রাষ্ট্র আরও বৈধতা অর্জন করেছে। এই বিশয়গুলো সাধারণত ফিসকাল বা অর্থনৈতিক কুশলীদের দ্বারা পরিচালিত হয়। 

এবার আসা যাক রাষ্ট্রের মুদ্রা তৈরির একচেটিয়া ক্ষমতার কথায়। রাষ্ট্রের তৈরি মুদ্রা সমাজে বিনিময়ের প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে। একটি দেশের মুদ্রার মূল্য সেই রাষ্ট্রের হাতে থাকা স্বর্ণ, রৌপ্য, বিদেশী মুদ্রার ভাণ্ডারের উপর নির্ভর করে। যেহেতু বেশিরভাগ দেশে স্বর্ণ বা রৌপ্য খনি নেই, তাই বেশিরভাগ রাজ্য বিদেশ থেকে ঋণ/বিনিয়োগ ও রপ্তানি করার জন্য তার দেশের উৎপাদিকা শক্তির উপর নির্ভর করে। একটি দেশ যত বেশি সোনা, রৌপ্য বৈদেশিক মুদ্রা পায় (রপ্তানী করে বা বিনিয়োগ/ঋণ টেনে) তার রাষ্ট্র কর হিসাবে তত বেশি স্বর্ণ, রৌপ্য, বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করতে পারে, তত বেশি মূল্য সেই দেশের মুদ্রা বহণ করে। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি বেশিরভাগ মুদ্রা ইস্যু করে। অতীতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার এই কাজ করত। মুদ্রা একটি দেশের মধ্যে বিনিময়ের মাধ্যমকে মানসম্মত করে যা বাণিজ্যকে আরও সুবিধাজনক করে তোলে। এটি সমৃদ্ধি ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে যা রাষ্ট্রকে আরও বেশি কর সংগ্রহ করতে সহায়তা করে। তবে অনেক ক্ষেত্রে কোনও দেশে যদি জনসংখ্যার তুলনায় বিশাল পরিমাণে বিদেশি মুদ্রা আয় করার মতো কোনও রাপ্তানী যোগ্য সম্পদ থাকে বা বিশাল বিদেশি বিনিয়োগ টানার মতো বুনিয়াদ থাকে তাহলে সেই দেশ জনতার কাছ থেকে সেভাবে কর নাও নিতে পারে। উপকূলীয় আরব দেশগুলো এই ক্ষেত্রে দ্রষ্টব্য। 

এখন রাষ্ট্রের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে আসা যাক এবং তা হল প্রোপাগান্ডা নেটওয়ার্ক বা প্রচার মাধ্যম। এর কাজ হল রাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত ব্যবস্থা ঠিকঠাক চলছে কি না তা দেখাশোনা করা। যেমন পুলিশ, আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ, সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা বিভাগ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক/ট্র্যাজারি তাদের দায়িত্ব পালন করছে কি না। প্রোপাগান্ডা নেটওয়ার্ক বা প্রচার মাধ্যম বলতে বোঝায় প্রিন্ট মিডিয়া, ডিজিটাল মিডিয়া, ধর্মীয় ও আদর্শিক প্রতিষ্ঠান, উৎসব, বিভিন্ন ধরণের বিনোদন, ক্লাব ইত্যাদি। প্রচার মাধ্যম জনতার মধ্যে বিভিন্ন ধারণা এবং দৃষ্টিভঙ্গি ছড়িয়ে দেয় যা সাধারণ মানুষকে তাদের নিজ নিজ রাষ্ট্রের সমর্থক বানিয়ে তোলে।  

এখন আমরা একটি সম্পূর্ণ রাষ্ট্র দেখতে পাচ্ছি যার সমস্ত যন্ত্রপাতি রয়েছে: সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা বিভাগ, পুলিশ, আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক/ট্রেজারি বা কোষাগার, ফিসকাল/ অর্থনৈতিক কুশলী এবং প্রোপাগান্ডা নেটওয়ার্ক বা প্রচার মাধ্যম।

এই যন্ত্রগুলো ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ হল রাষ্ট্রের রাজস্ব আয়ের সবচেয়ে বড় অংশ যারা ভোগ করে এবং যারা সবচেয়ে বেশি কর দেয়। প্রথম দলটি রাজনীতিবিদ এবং পরবর্তী গ্রুপটি বিগ বিজনেস। রাজনীতিবিদরা সংগৃহীত করের সর্বাধিক অংশ উপভোগ করে এবং বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো বা বিগ বিসনেস করের সর্বাধিক অংশ প্রদান করে্। 

কখনো কখনো রাষ্ট্র সংগ্রহ করা রাজস্বের চেয়ে বেশি ব্যয় করে এবং তারপরে তাকে এই বিগ বিজনেস-এর কাছ থেকে ঋণ নিতে হয়। রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ও পুলিশ আছে, বড় ব্যবসায়ীদের নেই। ফলে চাইলে রাজনীতিবীদেরা বড় ব্যবসায়ীদের সম্পত্তি দখলও করতে পারে। তাই রাজ্যগুলি প্রায়শই বিগ বিজনেসকে ধার দিতে বাধ্য করে এবং তখন বিগ বিজনেসের কাছে দুটি বিকল্প থাকে: হয় রাষ্ট্রকে ধার দেওয়া বা সেই রাজ্য থেকে অন্যত্র পালিয়ে যাওয়া। কিন্তু আবার যদি রাজনীতিবিদেরা যথেষ্ট শক্তিশালী হয় তবে তারা ঋণ দেওয়ার পরিবর্তে বড় ব্যবসাকে কর দিতে বাধ্য করবে। বিগ বিজনেস প্রায়ই বিদেশে চলে যাওয়ার মাধ্যমে কর এড়িয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে যদি বিগ বিজনেস রাষ্ট্রকে কর না দিয়ে ঋণ দেয় তাহলে বলা যায় রাজনীতিবিদদের থেকে বিগ বিসনেস-এর ক্ষমতা বেশি কারণ ঋণ রাষ্ট্রকে ফেরত দিতে হবে সুদ সমেত কিন্তু কর ফেরত দিতে হবে না রাষ্ট্রকে।

Author: Saikat Bhattacharya


You may also like