
আমাদের সমাজের একটা গভীর ব্যাধি হল Individualization of Failure and Collectivization of Success। অর্থাৎ ব্যার্থতার ব্যাক্তিকরণ ও সাফল্যের সমষ্টিকরণ। এটা একটু গভীরে দেখে নেওয়া যাক।
যখনই কোন মানুষ তার জীবনে কোন ব্যার্থতার সম্মুখীন হয় তখনই সমস্তকিছুর দায় একান্তই তার নিজের ঘাড়ে চাপানো হয়। অথচ ঠিক উল্টোদিকে যখন সে সফল হয় তখন তার সাফল্যের কৃতিত্ব নেওয়ার জন্য লোকজন হামলে পড়ে। অথচ সে যখন সেই সাফল্যের জন্যে দিনরাত এক করে সংগ্রামে অবতীর্ণ ছিল তখন সেই লোকেদের টিকিটিও দেখা ছিলনা। আবার সেই মানুষই যখন পরে কোন বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে তখন তার দুরবস্থা ভাগ করে নেওয়ার লোক পাওয়া যাবেনা। অর্থাৎ আমরা ব্যার্থতার দায় কোন নির্দিষ্ট ব্যাক্তির উপর আরোপ করছি অথচ সাফল্যের কৃতিত্ব গোটা সমষ্টি নিয়ে নিচ্ছে। ইহা তো সচরাচর ভণ্ডামি ও দ্বিচারিতা। যদি ব্যার্থতার দায় একান্ত ব্যাক্তিটির উপরেই হয় তাহলে সাফল্যের কৃতিত্বও একান্ত তার নিজের।
আসলে সাফল্য-ব্যার্থতা নিয়ে আমাদের মনে এক বাইনারি বদ্ধমূল ধারণ গেঁথে গেছে। আমাদের কাছে ব্যার্থতা মানে অযোগ্যতা বা অলসতা এই ধরণের এক অতি সরলীকৃত ধারণা জন্মেছে। সাফল্যের পেছনেও গাদাগুচ্ছের ফ্যাক্টর আছে সেটাও অতি সরলীকৃত মনে ধরা দেয়না। মানুষের জীবনে যেকোন মুহূর্তে কোন বিপর্যয় নেমে আসতেই পারে। সেইকারণে সে পথেও বসতে পারে। কিন্তু তাতে তার অক্ষমতা প্রমাণিত হয়না। সাফল্যের জন্যেও লাগে সঠিক সুযোগ, প্ল্যাটফর্ম, প্রশিক্ষণ, সাপোর্ট-সিস্টেম ইত্যাদি। আর শুধু পরিশ্রম দিয়ে কিছু হয়না। এটাও একটা ভুল ধারণা। পরিবেশ, যোগাযোগ, সময়, আর্থসামাজিক অবস্থা এবং সবশেষে ভাগ্যও বিরাট পার্থক্য গড়ে দেয়।
আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে যত উচ্চস্থানে যেতে চাইবে তাকে তত বেশী ঝুঁকি নিতে হবে, প্রতিযোগীতাতে নামতে হবে ও প্রতিকূলতার মোকাবিলা করতে হবে। 1000 জন উচ্চমেধা,গুণসম্পন্ন,পরিশ্রমী লোকের মধ্যে প্রতিযোগীতাতে 1 জন বিজয়ী হয়ে আসে। কিন্তু বাকী 999 জন কী এই একজনের থেকে কম কোনকিছুতে? তাতো নয়। তাহলে তারা যে এত সময়, সম্পদ, শ্রম, মেধা এতকিছু দিয়ে এত কাঠখর পোড়াল সেটার স্বীকৃতি কোথায়? অথচ এদেরকে ব্যার্থ দাগাবে তারাই যারা এদের কোনকিছুতেই ধারেকাছে নেই। জীবনে উন্নতি করতে হলে ঝুঁকি নিতেই হবে। এখন এই ঝুঁকিতে সাফল্যের থেকে ব্যার্থতার সম্ভাবনাই বেশী। এবার যারা ব্যার্থ হল তারা কোন যুক্তিতে অক্ষম প্রমাণিত হল?তাদের অন্তত যে এই ঝুঁকিটা যে নিল সেটার জন্য পুরষ্কৃত করা হল কী?আর যত উপরের দিকে উঠবে মানুষ তত হাজার একটা প্রতিকূলতার মোকাবিলা করতে হয়। এবার হতেই পরে কোন প্রতিকূলতার সামনে পড়ে সে একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ল। তো তাতে কী সে ফেলনা হল? হলনা। জীবন অনিশ্চিত, তাই কোন বিপর্যয় আসতেই পারে।
এবার কথা হল যারা নিশ্চিত,সুরক্ষিত,সাধারণ, গতানুগতিক জীবনযাপন করে তাদের পক্ষে উপরোক্ত মানুষের মর্ম বোঝা সম্ভব না। কারণ তাদের এই খুব বেশী হলে মিডিওকার,গতেবাঁধা জীবনে পৌঁছতে অত ঝুঁকি, প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়না। তাই তারা উপরোক্ত ক্ষেত্রে বিফল হওয়া মানুষদের খুব সহজেই অযোগ্য,অলস ইত্যাদি বলে দাগিয়ে দেবে। কিন্তু গুণগত মানে ঐ ব্যাক্তিরাই কিন্তু উত্তম মানের। শুধু লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি এটাই যা।
এবার কথা হল এই ঘটনা যদি বারেবারে চলতেই থাকে তাহলে মানুষের মধ্য ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা কমবে, প্রতিযোগীতা করার বাসনা কমবে, উন্নতির শীর্ষে যাওয়ার বাসনা আস্তে আস্তে কমবে। বেশী উপরে ওঠার মোটিভেশন পাবেনা আর। এইসমস্ত লোকেরা ধীরে ধীরে ঝুঁকিবিহীন,নিশ্চিত, আরামের মোটামুটি জীবন বেছে নেবে। ফলে গোটা সমাজ বিশাল পরিমাণ মানবসম্পদ,সম্ভাবনা,মেধা থেকে বঞ্চিত হবে। ফলে সমাজে,অর্থনীতিতে দেখা দেবে স্থবিরতা এবং আস্তে আস্তে ক্রমঅধঃপতনের সূচনা পাবে।
সুতরাং সমাজের অগ্রগতির জন্য সাফল্য-ব্যার্থতার বাইনারি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
Author: Purandhar Khilji