হেলেন


'একটা হেলেনের জন্যেই ট্রয় ধ্বংস হয়'-এই প্রচলিত কথা আমরা সবাই অনেকবার শুনেছি অর্থাৎ সুন্দরী নারীর ক্ষমতা এমনই যে তার জন্য আচ্ছা আচ্ছা পুরুষ মারামারি করা থেকে একটা আস্ত নগরী ধ্বংস করে দিতে পারে কিন্তু এই কথাটা সম্পূর্ণ সত্যি কী? উত্তরের অনুসন্ধান করা যাক ট্রয়ের যুদ্ধ ঐতিহাসিকভাবে হয়েছিল, কিন্তু তা হেলেনের জন্য হয়েছিল কী আদৌ? যাই হোক আপাতত মহাকাব্যেই থাকি, পরের এক লেখাতে ইতিহাসে আসব

ইলিয়াডের মূল নায়ক আকিলিস হেক্টরের মৃত্যুতেই ইলিয়াড শেষ ট্রোজান যুদ্ধের পরবর্তী ঘটনার বিবরণ ওডিসিতে দেওয়া তার নায়ক ওডিসিউস কাঠের ঘোড়াও ওডিসিউসেরই আইডিয়া ট্রয়ের রাজা প্রিয়ামকে হত্যা করেও আকিলিসের পূত্র নিপোটলেমাস যদি হেলেনকেই মূখ্য নায়িকা ধরতে হয় তাহলে মূখ্য নায়ক হয় মেনেলাস বা প্যারিস হবে, কিন্তু তা তো নয় আসল ব্যাপারটা ছিল হেলেনের জন্য প্রচুর পাণিপ্রার্থী ছিল স্বয়ম্বরের আগে তাদের সবাইকে একটা প্রতিজ্ঞা নিতে হয় যে হেলেন যাকেই পছন্দ করুক, ভবিষ্যতে হেলেনের সম্মান, সম্ভ্রমরক্ষা এবং প্রতিরক্ষার দ্বায়িত্ব তাদের সকলের এবং দরকার পড়লে প্রাণ দিয়ে হলেও তাদের দ্বায়িত্বপালন করবে তাই যখন হেলেনকে প্যারিস অপহরণ করে,তখন এই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েই সেইসব মহারথীরা যুদ্ধে গেছিল আগামেমননের কাছে অবশ্য ট্রয় বিজয়ই মূল লক্ষ্য ছিল তিনি ছিলেন মাইসিনির রাজা ব্রোঞ্জযুগের মূলভূমির গ্রীসে মাইসিনিই সবচেয়ে শক্তিশালী রাজ্য ছিল ট্রয় জয় তার সেই ভূরাজনৈতিক শক্তির প্রদর্শন ছিল এইকারণে এই সময়কালকে মাইসিনীয় গ্রীক সভ্যতা বলা হয়

কিন্তু আকিলিস ছিল his own man সে হেলেনের পাণিপ্রার্থী ছিলই না, তাই কোন প্রতিজ্ঞাবদ্ধও ছিলনা বরং আকিলিসেরই পাণিপ্রার্থীর অভাব ছিল না কারণ আকিলিস যুদ্ধবিদ্যায় ছিল অসম্ভব রকমের পটু, শারিরীক মানসিকভাবেভাবে শক্তিশালী সুঠাম এর আগে বহু রাজ্যজয়ে সেই রাজ্যেরই কোন না কোন নারী তাকে সহায়তা করেছে তাকে পাওয়ার জন্যে থেকেই বোঝা যায় শক্তিশালী,গুণবান পুরুষের কখনো নারীর অভাব হয়না তাই তারা একটা নারীকে নিয়ে অত বেশী ভাবিত থাকেনা আকিলিস হেলেন বা ট্রয় কিছুর জন্যেই যুদ্ধে আসনি এসেছিল নিজের সম্মান,গৌরব বৃদ্ধি এবং war prize জন্য ট্রোজান যুদ্ধ দ্বিপাক্ষিক ছিলনা সম্পূর্ণভাবে, আকিলিস তার নিজস্বপক্ষ ছিলHe was his own man আর তার অন্তরঙ্গ বন্ধু প্যাট্রোক্লাস তার পক্ষে ছিল বহুসময়েই সে মূল যুদ্ধে না থেকে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে যুদ্ধ করতে চলে যেত সেখান থেকে ধনসম্পদ,বন্দিনী নারী ইত্যাদির জন্য তার যুদ্ধের উদ্দেশ্যই ছিল গৌরববৃদ্ধি পরে যখন আগামেমনন তার বন্দিনীকে কেড়ে নেয় তখন সে সোজাসুজি বলে দেয় যে আর যুদ্ধ করবে না সকল মহারথীদের মধ্যে একমাত্র তারই এটার ক্ষমতা ছিল এতেই তার আসল শক্তির প্রদর্শন হয় শুধুমাত্র শারীরীক বলে কিছু হয়না, মানসিক গঠন ক্ষমতাই আসল আকিলিসকে স্বয়ং ট্রয়ের এক রাজকুমারীও চেয়েছিলেন সেই একই সূত্র পরে হেক্টরের হাতে পাট্রোক্লাস নিহত হলে আবার ক্ষোভে যুদ্ধে ফেরত আসেন এবং আগামেমনন তার বন্দিনীকে ফেরত দিয়ে আবার তার সাথে সমঝোতা করে নেন এখানেও তার সেই ক্ষমতার প্রদর্শন হল আরেকবার এরপর যুদ্ধে মোক্ষম কাজটাও তার, হেক্টরবধ এখানেই ইলিয়াডের পরিসমাপ্তি পরে যুদ্ধে আকিলিসের মৃত্যুও বীরের মৃত্যু যেখানে স্বয়ং আগামেমননকে নিজের স্ত্রী তার প্রেমিকের হাতেই নিহত হতে হল দেশে ফেরার পর প্যারিস নিহত হবার পর তার বিবাহ ট্রয়ের আরেক রাজকুমার দিফোবাসের সাথে হয় তারপর যুদ্ধশেষে হেলেন আবার মেনেলাসের কাছে ফিরে আসেন, মেনেলাস তাকে হত্যা করতে গিয়ে তার রূপে মোহিত হয়ে তাকে ফিরিয়ে নেন সুন্দরী নারী যতই অন্যায় করুক, মানসিকভাবে দূর্বল পুরুষ তা মেনে নেবে আর রোমিও প্যারিসের পরিণতি কী? দ্বন্দ্বযুদ্ধে মেনেলাসের কাছে হেরে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কাপুরুষের মত পলায়ন করে, যুদ্ধেও তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেননি আকিলিসবধ ছাড়া(সেটাও দূর থেকে আকিলিসিকের শরীরের দূর্বলতম অংশে তীরনিক্ষেপ করে) যুদ্ধে বীরের গৌরবও জোটেনি, শেষমেষ নিহত হয় সেই তীরেই তার মৃত্যুর পরে হেলেন সঙ্গে সঙ্গে অন্য পুরুষের কাছে চলে যান, তাহলে মৃত্যুর পরেও সে পরাজিত হল, হেলিনের কাছেও সে disposable এই ট্রোজান যুদ্ধ অনেককিছু শেখায় আমাদের, একদম কঠোর বাস্তব শিক্ষা ইলিয়াডও এমনিতে কোন যুদ্ধের বর্ণা নয়, শিক্ষামূলক কাব্য

1. দূর্বল, সাধারণ পুরুষরা সুন্দরী নারীর সামনে   অসহায় এরাই একটা নারীর জন্য নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষেও পিছপা হয়না কিন্তু শেষপর্যন্ত এদের নাম ওঠেই খরচের খাতাতে

2. অতিসুন্দরী নারীর কাছে একটা পুরুষের কোন বিশেষ গুরত্ব নেই তার কাছে খুব উচ্চমানের পুরুষ ছাড়া বাকিরা replacable এক পুরুষ গেলে আরেক পুরুষের কাছে যেতে কখনো অসুবিধা হবেনা তাদের কারণ তাদের পাণিপ্রার্থীর অভাব নেই

3. অর্থ, ক্ষমতা, শারিরীক শক্তি, শীর্ষস্থানে অধিষ্ঠিত থাকলেই যে সে আদতে উচ্চমানের পুরুষ হবে তার কোন গ্যারান্টি নেই কারণ এগুলো কোনটাই চিরস্থায়ী না এগুলো থাকা সত্বেও হাজার হাজার পুরুষ নারীর সামনে নতমস্তক হয়

4. বেশীরভাগ পুরুষই এমনকি আচ্ছা আচ্ছা পুরুষও সুন্দরী নারীর হাজার দোষ ক্ষমা করে দেবে, সব অন্যায় মেনে নেবে কারণ তারা মানসিকভাবে সেই নারীর হাতের পুতুল সেই নারীর সাথে সামান্য সময় কাটানোর জন্য সবকিছু উজার করতে পারে মানসিক দূর্বলতা বাকি সব শক্তিকে negate করে দেয় এছাড়াও শক্তিশালী,শীর্ষস্থানীয় পুরুষেরা নারীর কাছে পরাজিত হন আগামেমননের মতো

5. মানসিক শক্তি, মনন, চারিত্রিক গঠন, জীবের দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি এগুলোই উচ্চমানের  পুরুষ গড়ে তার সাথে অবশ্য উপরোক্ত সব গুণ থাকতে হবে উচ্চমানের পুরুষ স্বাধীনচেতা, কারুর ভৃত্য নয় সে কোন নারীর জন্য উন্মত্ত হয় না, নারীরাই তার জন্যে পাগল কারণ তার নারীর অভাব নেই তার কাছে নারীরা replacable/disposable, সে নারীর কাছে priceless তার ক্ষমতা,শক্তির উৎস সে নিজেই,কোন বাহ্যিক উৎস না তার জীবন ক্ষুদ্র নয়, অন্য কাউকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় না তার কাছে তার নিজের মর্যাদা, গৌরব, অর্জন, legacy সবার উপরে তার কাছে মাথা উঁচু করে মৃত্যুবরণ মাথা নীচু করে বাঁচার চেয়ে শ্রেয়

6. প্যারিসের মতো রোমিওদের পরিণতি সর্বদাই করূণ হয় তারা খুব বড়জোড় ট্রাজিক চরিত্র হতে পারেন, বিজয়ী কখনো হবে না জীবনযুদ্ধে তারা পরাজিতই হবে তারপর মুছে যাবে আর যে নারীর জন্য জীবন উৎসর্গ করল, সে নারী নিমেষেই অন্য পুরুষের কাছে চলে যাবে

7. চরম থেকে চরমতম শক্তিশালীরও একটা না একটা দূর্বলতা থেকেই যায় পারফেক্ট কেউ না এবং সে দূর্বলতাও একসময় মারাত্মক হতে পারে মানুষ মাত্রেই ইমপারফেকশন থাকবে, এটাই বাস্তব

হেলেনদের জন্য মেনেলাস, প্যারিস এবং আরো সাধারণ পুরুষরাই মারামারি করে এবং ট্রয় ধ্বংস করে আকিলিসদের কাছে হেলেন, ট্রয় এসব অতি ক্ষুদ্র জিনিস, তাদের জীবন অনেক বৃহৎ তাদের আকঙ্খাও অসীম, যাদের কাছে গৌরব, মহিমা, legacy এসবের মূল্য বেশী একটা হেলেন তার কাছে অতি তুচ্ছ, কারণ ওরকম হাজার হাজার হেলেন তার জন্যে অপেক্ষা করে এবং সর্বশেষে বীরগাথাও রচিত হয় এই আকিলিসদের কেন্দ্র করেই এরাই ইতিহাস গড়েআমরা আসলে আকিলিসদের সাথে মেনেলাস, আগামেমনন, প্যারিসদের গুলিয়ে ফেলি বারবার, এবং তাতেই বড্ড ভুল করে বসি

Author: Purandhar Khilji


You may also like