
কার্ল মার্ক্স, লেনিন, মাও জে দং ও দেং শিয়াওফিং-এর চিন্তার ওপরেই চীনের কমিউনিস্ট পার্টি দাঁড়িয়ে আছে। মার্ক্স -এর থেকে তারা দীর্ঘমেয়াদী আন্তর্জাতিক লক্ষ্য সম্পর্কে দিক নির্দেশ পান, লেনিন পশ্চীমের ঐতিহাসিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের হাতিয়ার, মাও-এর থেকে চীনের পটভূমিকায় মার্ক্স ও লেনিন-কে ব্যবহার করার উপায় পান এবং দেং-এর সাহায্যে চীনের পরম্পরা গত শক্তির মেলবন্ধন ঘটানো হয় মার্ক্স লেনিন ও মাও-এর সাথে।
মার্ক্স মনে করতেন প্রযুক্তির অগ্রগতি একদিন এমন স্তরে পৌঁছে যাবে যে মানুষের করতে ভাল লাগেনা কিন্তু সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এমন সমস্ত ক্রিয়া করবে স্বয়ংক্রিয় মেশিন আর মানুষ কেবল এমন ক্রিয়া করবে যা সে করতে পছন্দ করবে। এই অবস্থা যখন তৈরি হবে তখন আমরা কমিউনিস্ট সমাজে পৌঁছব। যে মানুষ তার পছন্দের ক্রিয়া করে তাই সে কোনও বিনিময় মূল্যের (অর্থ) উদ্দেশ্যে সেই ক্রিয়া করবেনা আর তাই সমাজে সমস্ত ক্রিয়া ও উৎপাদন হবে সামাজিক। অর্থাৎ মুনাফার জন্যে কোনও বিনিয়োগ হবেনা আর অর্থের জন্যে কোনও কাজ হবেনা। এছাড়াও কোনও মানুষ অন্য মানুষকে ভয় বা লোভ দেখিয়ে নিজের স্বার্থে কোনো কাজ করিয়ে নিতে পারবেনা কারণ পছন্দ না হলে কেউ কোনো কাজই করবেনা। তাই সমাজ হবে শ্রেণিহীন। বিনিময় মূল্য ও শ্রেণি বিলুপ্ত হবে। সমস্ত ক্রিয়া ও উৎপাদন হবে সামাজিক আর তাই ব্যক্তি সম্পত্তি হয়ে যাবে সামাজিক সম্পত্তি।
কিন্তু মার্ক্স মনে করতেন আগে পুঁজির বিকাশ হতে হবে অর্থাৎ উৎপাদন ব্যবস্থা এতটাই স্বয়ংক্রিয় হয়ে উঠতে হবে যে সমাজের উৎপাদন শক্তি হবে বিশাল কিন্তু তার জন্যে সমাজের পূর্ণ শ্রম শক্তিকে ব্যবহার করার প্রয়োজনীয়তা থাকবেনা। ফলে সমাজে শ্রমিক শ্রেণির আসল মজুরি ততটা বৃদ্ধি পাবেনা যতটা পুঁজিপতি শ্রেণির মুনাফা বৃদ্ধি পাবে। যেহেতু শ্রমিকদের বিশাল অংশই ক্রেতা তাই সমাজের ক্রয়ক্ষমতা সমাজের উৎপাদিকা শক্তির থেকে পিছিয়ে পড়বে। ফলে দেখা দেবে অতি উৎপাদন সঙ্কট। একে কাটাতে প্রয়োজন শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে বিপ্লবী রাষ্ট্র যে মুনাফাকে মূল লক্ষ্য না রেখে বিনিয়োগ করবে এবং এর ফলেই কেবল অতি উৎপাদন সঙ্কট কেটে যাবে। মুনাফা মূল লক্ষ্য থাকছেনা বলে বলা চলে সামাজিক বিনিয়োগ ও উদ্যোগ বেড়ে যাবে। ক্রমেই শ্রমিক শ্রেণি পরিচালিত রাষ্ট্র আরও বেশি স্বয়ংক্রিয় করে তুলবে উৎপাদনকে এবং শ্রকিকদের আরও বেশি সময় দেবে নিজের পছন্দ মতো ক্রিয়া করার জন্যে। এভাবেই আস্তে আস্তে সমস্ত করতে ভালো লাগেনা এমন কাজকেই স্বয়ংক্রিয় করে ফেলা হবে এবং সমগ্র মানব জাতিই পছন্দ মতো কাজ করতে পারবে। মার্ক্স -এর ধারণা ছিল যেহেতু মানুষ ব্যক্তিস্তরে পছন্দ মতো ক্রিয়া করার সুযোগ না পাওয়া পর্যন্ত বিনিময় মূল্যের জন্যেই কাজ করে যাবে তাই ব্যক্তি মালিকানাধীন সংস্থা দিয়ে সামাজিক বিনিয়োগ বা উদ্যোগ সংগঠিত করা সম্ভব নয়। অতএব সামাজিক উদ্যোগ বা বিনিয়োগ করতে পারে কেবল শ্রমিক পরিচালিত বিপ্লবী রাষ্ট্র।
লেনিন বলেন বিংশ শতকে পুঁজিবাদ প্রতিযোগিতামূলক পুঁজিবাদ থেকে একচেটিয়া (মূলত ওলিগোপলি) পুঁজিবাদে পরিণত হয়েছে। পুরো উৎপাদন ব্যবস্থা বৃহৎ ধনী পুঁজির মালিকেরাই নিয়ন্ত্রণ করছে। মধ্যবিত্ত পুঁজির মালিকেরা (যাদের ফরাসী ভাষায় বুর্জোয়া বলা হয়) উৎপাদনে প্রান্তিক অবস্থান নিয়েছে। ফলে তাদের পক্ষে আর আগের মতো বুর্জোয়া সংস্কার ঘটিয়ে সামন্ততন্ত্র ভেঙ্গে উৎপাদনের বিকাশ ঘটানো সম্ভব নয়। এই বুর্জোয়া সংস্কার ঘটিয়ে সামন্ততন্ত্র ভেঙ্গে উৎপাদন ও স্বয়ংক্রিয়তা বিকাশের কাজও করতে হবে শ্রমিক শ্রেণিকেই। ফলে লেনিন শিল্পায়ণের দায়িত্ব শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্রকেই দেন। এছাড়াও উনি দেখান যে সামাজিক উৎপাদন ও বিনিয়োগ কেবল অতি উৎপাদন সংকটেই কার্যকর হবে তা নয়। বরং শিল্পায়ণ ও স্বয়ংক্রিয়তা বিকাশেও সামাজিক বিনিয়োগ (মুনাফা যেখানে মূল লক্ষ্য নয়) ফলদায়ক। সোভিয়েত শিল্প্যণের দ্রুতগামীতা প্রমাণ করে যে শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী রাষ্ট্র সামাজিক বিনিয়োগ করে ভারী শিল্প ও পরকাঠামো এবং শিক্ষা স্বাস্থ্য খুব দ্রুত উন্নত করে ফেলতে পারে। বলা যায় বুনিয়াদী শিল্প শিক্ষা স্বাস্থ্য এবং গবেষণার মতো ক্ষেত্রে রাষ্ট্র চালিত সামাজিক বিনিয়োগ খুবই ফলদায়ক হয়। স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত শিল্প ও শিল্প বলের ওপর নির্ভরশীল সামরিক ক্ষমতা জার্মানি ব্রিটেন ফ্রান্স-কে ছাপিয়ে যায়।
কিন্তু ১৯৫০-এর দশকে এসে প্রমান হয় যে ভারী শিল্প, পরিকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও গবেষণাতে এগিয়ে থাকলেও হাল্কা ও ভোগ্যপণ্য শিল্পে রাষ্ট্র পরিচালিত সামাজিক বিনিয়োগ ভাল ফল দিচ্ছেনা। উদ্ভাবনমূলক শিল্পেও কোনো ফল পাচ্ছেনা রাষ্ট্র চালিত সামাজিক বিনিয়োগ। মাও রাষ্ট্র চালিত সামাজিক উদ্যোগগুলোর আমলাতান্ত্রিক দুর্বলতার কথা তুলে ধরেন। এবং গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত সামাজিক উদ্যোগ তৈরি করে হালকা ও ভোগ্যপণ্য শিল্পের বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু সেই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। ১৯৮০-এর দশকে দেং বলেন ভারী শিল্প, পরিকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও গবেষণাতে এগিয়ে থাকলেও হাল্কা ও ভোগ্যপণ্য শিল্পে রাষ্ট্র পরিচালিত সামাজিক বিনিয়োগ থাক আর হাল্কা ভোগ্যপণ্যের শিল্পে ব্যক্তিমালিকানাধীন মুনাফা কেন্দ্রিক উদ্যোগ থাক। দেং-এর মডেল চীনের দ্রুত অগ্রগতি ঘটায়। কিন্তু ২০০৮ সালের পর থেকে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি আশঙ্কিত হয়ে ওঠে এই জন্যে যে উদ্ভাবনমূলক উদ্যোগে চীন তখনো পিছিয়ে।
ব্যক্তির স্বপ্ন ও উদ্যোগ ছাড়া উদ্ভাবন প্রায় অসম্ভব। আবার উদ্ভাবনমূলক শিল্প মূলত তৈরি হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আর সেখানে কোন সংস্থা উদ্ভাবনমূলক বিনিয়োগ করে সফল হবে তা নিয়ে ফাটকাবাজি (সংস্থার শেয়ার কেনাবেচা করা) করে মুনাফার আশায়। এর ফলে মার্কিন শেয়ার বাজারে বুদবুদ তৈরি হয় আর সেই বুদবুদ যখন ফাটে তখন অর্থনৈতিক সঙ্কট তৈরি হয়। তার চেয়েও বড় কথা এভাবে বারবার উদ্ভাবনমূলক ক্ষেত্রে বিনিয়োগ টানতে গেলে খুব শক্তিশালী মুদ্রা দরকার যা সেই দেশের শিল্পোতপাদনকে বিনিয়োগশূন্য করে দেয় আর সমস্ত বিনিয়োগ চলে যায় সম্পত্তি কেনাবেচার ব্যবসাতে। তাই মুনাফা কেন্দ্রিক উদ্ভাবন ব্যবস্থা চীনের পছন্দ নয়।
তখন চীনের কমিউনিস্ট পার্টি স্মরণাপন্ন হয় বাংলাদেশের বিখ্যাত নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত মহম্মদ ইউনূস-এর। ইউনূস বলেন যে একজন ব্যক্তি সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ করবেন যদি সেই উদ্যোগ থেকে সমাজ লাভবান হয় এবং সমাজের বহু মানুষের আনন্দ সামাজিক বিনিয়োগকারীকেও আনন্দ দেয়। অর্থাৎ একজন ব্যক্তি মুনাফাকে মূল লক্ষ্য না করে সমাজের ভালো করে যে আনন্দ সেই আনন্দকেও লক্ষ্য করে সামাজিক বিনিয়োগ ঘটাতে পারে। অর্থাৎ মার্ক্স লেনিন যেখানে সামাজিক বিনিয়োগের জন্যে কেবল রাষ্ট্রের স্মরণাপন্ন হওয়ার কথা ভেবেছিল সেখানে ইউনূস ব্যক্তির মধ্যেই সামাজিক বিনিয়োগের উৎস খুঁজে বের করেন। ইউনূসের সামাজিক উদ্যোগ ব্যবহার করে বহু দেশ রাষ্ট্রকে ছাড়াই দারিদ্র্য দূর করতে সক্ষম হয়। পশ্চীমি দুনিয়া বারবার ইউনূসের সামাজিক উদ্যোগকে যেখানে দারিদ্র্য দূরীকরণের উপায় হিসেবে কেবল দেখে, চীন সেখানে ইউনূসের তত্ত্ব ব্যবহার করে উদ্ভাবনী ক্ষেত্রকে বিকাশ করার কথা ভাবোতে লাগল।
চীন দেখল সমাজের আনন্দ বা অগ্রগতি যদি ব্যক্তি আনন্দের উৎস হয় তবে ব্যক্তি সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। তাহলে উদ্ভাবনী ক্ষেত্রে বিকাশ ঘটিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং মার্কিন অবরোধকে পরাজিত করাও ব্যক্তি আনন্দের উৎস হতে পারে। আবার ব্যক্তি উদ্ভাবনী স্বপ্নকে ফলপ্রসূ করতেও মুনাফাকে প্রধান লক্ষ্য না রেখে বিনিয়োগ করতে পারে। এইভাবে ইউনূসের সামাজিক উদ্যোগ-কে নিজেদের উদ্ভাবনী ক্ষেত্র বকাশে কাজে লাগাতে থাকে চীন। চীনের বিভিন্ন শহরের পুরসভাগুলো বিপুলভাবে বিনিয়োগ করতে থাকে এমন সব ব্যক্তি মালিকানাধীন সামাজিক উদ্যোগে যেখানে উদ্ভাবন করাটাই মূল লক্ষ্য, মুনাফা গৌণ। ডিপসিক-এর প্রতিষ্ঠাতা লিয়াং ওয়েংফেং বলেছেন তাদের মূল লক্ষ্য উদ্ভাবনের ব্যবহারমূল্য, মুনাফা বা বিনিময়মূল্য তাদের কাছে গৌণ। আর এই জন্যেই ডিপসিক-কে পুরোপুরি বিনামূল্যে ছাড়া হয়েছে বাজারে। এর আগে চীন কোভিড ভ্যাক্সিনও বিনামূল্যে বাজারে আনে কিন্তু সেই ভ্যাক্সিন উভাবক ছিল রাষ্ট্র (মনে রাখা দরকার স্বাস্থ্য ও গবেষণায় রাষ্ট্র চালিত সামাজিক বিনিয়োগ যথেষ্ট ফলদায়ক)। কিন্তু ডিপসিক-এর উদ্ভাবক ব্যক্তি হওয়া সত্তেও সামাজিক উদ্যোগ নিয়েছে। এছাড়াও মার্কিন উদ্ভাবনী ক্ষেত্র মুনাফাকেন্দ্রিক হওয়ায় প্রচুর বিনিয়োগ টেনে আনাকেই লক্ষ্য ভাবে এবং এইভাবে উদ্ভাবনের খরচ অনেক বাড়িয়ে তোলে। চীনা উদ্ভাবনী মডেল সামাজিক হওয়ায় উদ্ভাবনের উপযোগিতা বা ব্যবহার মূল্যের ওপর জোড় দেয় এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি বা খরচ বৃদ্ধি কম হয়। তাই ডিপসিক তৈরি করতে খরচ হয়েছে চ্যাট-জিপিটি-র এক তিরিশাংশ।
চীনের মডেল এখনো পর্যন্ত এরকমঃ
ভারী বুনিয়াদী পরিকাঠামো শিল্প ও পরিষেবাঃ রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক
শিক্ষা স্বাস্থ্য গবেষণাঃ রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক
হাল্কা ভোগ্যপণ্য শিল্প ও পরিষেবাঃ ব্যক্তিমালিকানা ও মুনাফাকেন্দ্রিক
উদ্ভাবনমূলক শিল্প ও পরিষেবাঃ ব্যক্তিমালিকানাধিন ও সামাজিক
সামাজিক = ব্যবহারমূল্য বা উপযোগিতা মাথায় রেখে উৎপাদন
মুনাফাকেন্দ্রিক = বিনিময়মূল্য বা মুনাফা মাথায় রেখে উৎপাদন
An Important Reference: https://beamstart.com/news/global-entrepreneurship-competition-hicool-2025?fbclid=IwY2xjawIsHt9leHRuA2FlbQEwAGFkaWQBqxnAChyT_gEdoPu_qatUrzVwouUuuAuTv5eHJzDvaC40k5iDCZwk9Xp7vHws6J3Y_wO0_aem_5ScT_u79zJvydJ2ysLMjYA
Author: Saikat Bhattacharya