
বাঙালি হিন্দু ১৮৭০ থেকে ইলবারট বিলকে কেন্দ্র করে ক্রমেই ব্রিটিশদের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। চীন ও বাংলা অষ্টাদশ শতকে ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বেশি শিল্পোন্নত অঞ্চল এবং সবচেয়ে বড় বাজার। কিন্তু ১৮৪০ এর পরে ব্রিটেন ও পশ্চীম ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়ে উঠতে শুরু করে সবচেয়ে বেশি শিল্পোন্নত অঞ্চল এবং সবচেয়ে বড় বাজার। ফলে পূর্ব দিকের কোলকাতার থেকে পশ্চীম দিকের মুম্বাই-এর গুরুত্ত্ব বাড়তে শুরু করে। কারণ চীন ও বাংলার সাথে যখন প্রধান বাণিজ্য তখন কোলকাতাই গুরুত্বপূর্ণ আর পশ্চীমের সাথে যখন প্রধান বাণিজ্য তখন মুম্বাই সুরাট ইত্যাদির গুরুত্ব বেড়ে যাবে। ১৮৭০ থেকে এটাই হচ্ছিল আর তাই বাঙালি হিন্দুর ব্রিটিশদের প্রধান বন্ধু হিসেবে থাকাটা অসম্ভব হচ্ছিল। তাই বাঙালি হিন্দু ও ব্রিটিশ দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়।
প্রথমে দ্বন্দ্বের জন্য বাঙালি হিন্দু বাংলা জাতিয়বাদের দিকে যায়। ১৮৮০-এর আদম সুমারী থেকে বোঝা যেতে থাকে যে বাংলা আস্তে আস্তে মুসলমান প্রধান অঞ্চল হয়ে যাচ্ছে। ব্রিটিশরা ১৮৫৭ শিপাই বিদ্রোহ থেকে শিক্ষা নেয় যে মোঘল ও ব্রাক্ষণ জোট ভাঙতে হবে কারণ ব্রিটিশ শিপাইদের ব্রাক্ষণ অংশ বিদ্রোহ করে কিন্তু রাজপুত অংশ ব্রিটিশদের প্রতি অনুগত থাকে। তাই হিন্দি অঞ্চলে রাজপুতদের ক্ষমতা বাড়াতে ও হিন্দু-মুসলমান দূরত্ব বাড়াতে হিন্দিকে উর্দুর থেকে পৃথক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ব্রিটিশরা ১৮৬৭ সালে আর সেন্ট্রাল প্রভিন্স (বর্তমান ইউপি) হিন্দিকে সরকারী ভাষা বানায় ১৮৮১ সালে। এইভাবে একটা বিশাল অঞ্চলকে হিন্দিভাষি বানিয়ে ফেলল ব্রিটিশরা।
ব্রিটিশরা বাঙালি হিন্দুদের বাঙালি জাতিয়তাবাদকে ভাঙতে হিন্দি ভাষা ও মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা দুতোকেই ব্যবহার করে। ১৯০৫-এ রিসলে সাহেব বলেন, "United Bengal is a power, once divided it will fall into different ways"। অর্থাৎ বাঙালি জাতিয়তাবাদকে ভাঙো। কার্জন বঙ্গ ভঙ্গ করতে চাইল এমনভাবে জাতে পূর্ব দিকে মুসলমানরা সংখ্যাগুরু হয়ে আর পশ্চীমে হিন্দিভাষিরা সংখ্যাগুরু হয়। এভাবে বাঙালি হিন্দুকে শক্তিহীন করে ফেলা সম্ভব। এই চাপের মুখে বাঙালি হিন্দু বলল বাঙালিকে এক রাখতে হবে। অর্থাৎ বাঙালি হিন্দু মুখে বলল যে তারা বাঙালি মুসলমানকে বেশি আপন মনে করে। কিন্তু কাজে এই মিলনের পক্ষে কোন আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলনা। শশঙ্ক ও ইলিয়াস শাহ-কে এক সূত্রে গাঁথতে হত। সিস্তানী, তুর্কি, পাঠানদের বিদেশি বলে যে তকমা বঙ্কিম চন্দ্ররা দিয়েছিল তা ভাঙতে হত। কিন্তু বাঙালি হিন্দু সেরকম কিছুই করতে পারলনা। উলটে এক দিকে চিত্তরঞ্জন দাশ বাংলার মুসলমানদের সাথে কোন আদর্শগত জোট না করে স্রেফ রাজনৈতিক জোট চালাতে লাগলেন আর রবীন্দ্রনাথ ভারতের মহামানবের সাগরতীর প্রচার শুরু করলেন।
বাঙালি হিন্দু এটা মেনে নিতে পারছিলনা যে বাংলাতে মুসলমান সংখ্যা ৫০%-এর ওপরে আর তাই বাংলা কখনোই আর উনবিংশ শতকের মতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেনা বাঙালি হিন্দু। তাই সে ১৯৩০-এর দশকে ভারতীয় জাতিয়তাবাদকে আঁকড়ে ধরছিল। কিন্তু ভারতকে হাতে রাখতে সে বাঙালি মুসলমানকে বাঙ্গালিত্বের মোড়কে সাঝাতে চাইছিল। এদিকে ১৯৩০-এর দশকে ফজলুল হকের সময় থেকেই কৃষক প্রজা পার্টি বানিয়ে বাঙালি মুসলমান দেখিয়ে দেয় স্বাধীন বাংলাতে নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠাই তাদের বেশি পছন্দের। এর মানে হল বাঙালি হিন্দু চাইছিল বাঙালি মুসলমান যেন তার সংখ্যা দিয়ে ভারতে বাঙালির সংখ্যা ও ক্ষমতা বাড়ায় আর বাঙালি মুসলমান চাইছিল স্বাধীন বাংলায় সংখ্যাগুরু হিসেবে নিজেদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে এবং বাঙালি হিন্দু যেন সেই কাজে বাঙালি মুসলমানকে বাঙ্গালিত্বের নামে সমর্থন করে। বাঙালি হিন্দু যা করতে পারত তা হল খুব শক্তিশালী সংখ্যালঘু হিসেবে স্বাধীন বাংলায় নিজেদের প্রতিষ্ঠা করা এবং সেখানে নিজেদের দাবিদাওয়া দরকষাকষির মধ্য দিয়ে সংখ্যাগুরু বাঙালি মুসলমানদের কাছ থেকে আদায় করা। সেটা না করে বাঙালি মুসলমানদের ওপর নিজেদের তৈরি উনবিংশ শতকের বাঙ্গালিত্ব চাপাতে গেল আর ভেবে গেল বাঙালি মুসলমানের সমর্থন নিয়ে ভারতকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
এরকম ভুল ভাবনা সফল হয়নি স্বাভাবিকভাবেই। বাঙালি হিন্দু পশ্চীম বঙ্গ নামে ভারতের মধ্যে ৮% জনসংখ্যার দুর্বল একটা রাজ্য তৈরি করল। ৪৭%-এর হিন্দিভাষি বা ৫২%-এর হিন্দি-গুজারাতি জোটের সামনে এই ৮% খুবই দুর্বল। এই ৮% বাঙ্গালির মধ্যে আবার ৩০% বাঙালি মুসলমান, ৩ঁঁ% উর্দুভাষি মুসলমান, ৮% হিন্দিভাষি ও ২% নেপালী। বাঙালি হিন্দু ৫৭%-এর বেশি নয় পশ্চীম বঙ্গে। আসাম, ত্রিপুরা ও ঝারখণ্ডে বসবাসরত বাঙালির মধ্যে সেরকম কোন উদ্দীপনা তৈরি করতে পারেনি। ১৯৪৭-এর ধাক্কা বাঙালিকে ভেঙেচুড়ে দিয়েছে। শুধু পাওয়ার মধ্যে বাংলাদেশ নামে একটা রাষ্ট্র তৈরি করতে পেরেছে বাঙালি মুসলমানেরা। বাকিটা একদম এলোমেলো হয়ে আছে। ইতিহাস এই এলোমেলো অয়ে যাওয়া জাতিকে খুব শিঘ্র একটা সুযোগ দিতে চলেছে। দেখা যাক.........।
Author: Saikat Bhattacharya