বাংলাদেশ-এর মধ্যপন্থী বিপ্লবীরা ব্যর্থ হল কেন? প্রতিকার কি?

12-March-2025 by east is rising 117

বামপন্থীদের সমস্যা

বামপন্থী নেতা কর্মীদের বিশাল একটা সমস্যা আছেঃ ছুঁকছুঁক করা। না, সেটা যৌনতার জন্যে হলে এতোটা খারাপ হতনা। তাদের ছুঁকছুকানি হল কিছু একটা করার। "কিছু কর", "কিছু কর"। এদিকে মার্কস লেনিন মাও তার ক্রিটিক কাউন্টার ক্রিটিক কিছুই পড়া নেই। আবছা আবছা গরীবের, শ্রমিকের, কৃষকের, নারীর পক্ষে থাকতে হবেঃ এইটুকু বোঝে। কিন্তু ১৯০০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত গড়ে ওঠা ধারণা দিয়ে ১৯৭০ পরবর্তী অবস্থাকে বোঝা যাচ্ছেনা কেন তা বিশ্লেষণ করেনা এই বামেরা।

কৃষক আন্দোলন আর নেই কেন?

বিংশ শতকের সত্তর দশক পর্যন্ত যেরকম জমির মালিকানা পিয়াসী কৃষক ছিল তা আজ নেই কারণ জমির আর আয়ের মূল উৎস নেই। এর কারণ শিল্পোন্নয়ন ১৯৪৫ থেকে ১৯৭০-এর মধ্যে অত্যন্ত দ্রুত হয়েছে, ১৯৭০-১৯৯০-এ খানিকটা গতি কমলেও শিল্পোন্নয়ন এগিয়ে গেছে, আর ১৯৯০-২০০৮-এর মধ্যে ৫০-৭০ ও ৭০-৯০-এর মাঝামাঝি একটা গতিতে শিল্পোন্নয়ন হয়েছে। ফলে এক দিকে জমির মালিকানা চাওয়া কেন্দ্রিক কৃষক আন্দোলন শেষ হয়ে গেছে আর অন্যদিকে কৃষি জমিতে শিল্প হওয়া-কে কেন্দ্র করে কিছু কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে ১৯৯০-২০০৮-এর মধ্যে। এনজিও কেন্দ্রিক প্রকৃতি বাঁচাও, সবুজ বাঁচাও আন্দোলন এই সময়ে খুব চলেছে। বামেরা তখন এই জমি সবুজ প্রকৃতি বাঁচানোর আন্দোলনে গাঁ ভাসায়। কিন্তু ২০০৮-এর মন্দার পরে শিল্পোন্নয়নের গতি কমায় সেই আন্দোলনেও ভাটা পড়েছে।

শ্রমিকের আন্দোলন দুর্বল কেন?

সমাজের জীবিকা হিসেবে কৃষির গুরুত্ব কমে শিল্পের গুরুত্ব বাড়ায় শ্রমিক সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু ১৯৭০-এর পর থেকে নারীরাও শ্রমিক হিসেবে বেশি বেশি করে যুক্ত হয়েছে শ্রম বাজারে আর এর ফলে শ্রমিক-এর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে দারুণ গতিতে। অর্থাৎ কেবল কৃষক থেকেই শ্রমিক হয়নি, ঘরের দেখভালের দায়িত্বে থাকা নারীরাও শ্রমিক হয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে স্বয়ংক্রিয়তা বা অটোমেশন-এর দ্রুতগতির বৃদ্ধি এবং অবশ্যই পুঁজির বিশ্বায়ণ যা পুঁজিকে স্বাধীনতা দিয়েছে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়ার। ফলে পুঁজি যে দেশে মুনাফা বেশি পাবে, সেখানে ছুটবে। মুনাফা সেখানেই বেশি হবে যেখানে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হার মজুরি বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি থাকবে। ১৯৮০ থেকে ২০২৫-এর মধ্যে চীন ও ভিয়েতনামের মতো সামান্য কিছু দেশ আছে যারা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হার লাগাতার বেশি রাখতে পেরেছে মজুরি বৃদ্ধির হার যথেষ্ট বৃদ্ধি করেও। খুব উচ্চ উৎপাদনশীলতা দেখাতে না পারলে মজুরি বৃদ্ধি করার আন্দোলন করা অসম্ভব বিশ্বায়ণের যুগে।কিছু ভোউগলিক সুবিধে থাকলে যেমন পৃথিবীতে অপ্রতুল এমন খনিজ সম্পদ থাকলে (গালফ আরব) বা উন্নত বড়ো দেশের নিকটবর্তী হলে (তুর্কিয়ে মেক্সিকো), বিশ্ব বাণিজ্যের পক্ষে আদর্শ স্থানে বন্দর থাকলে (সিঙ্গাপুর) কিছুটা দর কষাকষির জায়গা পায় বটে শ্রমিকেরা কিন্তু ১৯৭০-এর আগে যা পেত তার থেকে অনেক কম পায়।

অগত্যা নারী ও সংখ্যালঘু রাজনীতি

অধিকাংশ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো লুটেরা-বাণিয়া পুঁজি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত আর উৎপাদক পুঁজি থাকলেও তাদের সাথে আপোষ করে চলে। শ্রমিক শ্রেণির কোণঠাসা অবস্থা আগেই বলা হয়েছে। ফলে তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশই দ্রুত উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে পারেনা। তাই শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি করা কঠিন হয়ে যায়। মজুরি বৃদ্ধি হলে শিল্পায়ণের গতি থমকে যায়। তাই বর্তমানে শ্রমিককে ভিত্তি করে বামেরা আন্দোলন করতে পারেনা। কৃষকের ভূমি সংস্কার-এর আন্দোলনও নেই। ২০০৮ সালের পর থেকে প্রকৃতি সবুজ কৃষি জমিকে শিপ্লের জন্য ব্যবহার করার বিরোধিতা করে আন্দোলনও অনেক দুর্বল। তাই বামেরা এখন আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে নারী স্বাধীনতা ও তারই সাথে তৃতীয় লিঙ্গের স্বাধীনতার অন্দোলনে। এর বাইরে তারা খুব একটা বেরতেই পারেনা। এর সাথে যুক্ত হয় সংখ্যালঘু বাঁচাও আন্দোলন এবং মাঝেমাঝে গরীব বাঁচাও আন্দোলন। বামেরা "কিছু একটা করতে হবে" এমন মানসিকতা থেকেই নারী, তৃতীয় লিঙ্গ ও সংখ্যালঘু রক্ষা আন্দোলনে নেমে পড়ে।

পালটা রক্ষণশীল শ্বেতাঙ্গবাদ ও ইসলাম-এর উত্থান

কিন্তু এর ফল কি দাঁড়ায় তা নিয়ে নিজেদের কমিউনিস্ট পরিচয় দেওয়া বামেদের কোনও ব্যখ্যা নেই। কারণ আন্দোলন করে টিভি-তে ও সামাজিক মাধ্যমে মুখ দেখানোই এদের লক্ষ্য। এর ফল দাঁড়াচ্ছে ভয়াবহ। নারীর যৌন স্বাধীনতা প্রতিক্রিয়াশীল, বৈপ্লবিক নয়। মহিলারা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পাওয়ার পরে যৌন স্বাধীনতা চাইবে এবং মহিলাদের যৌন পছন্দের হাইপারগামিক প্রকৃতি (কেবল উচ্চ মানের পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া ও সাধারণ পুরুষদের কাছে যৌনতার বিনিময়ে উচ্চ মূল্য চাওয়া) সাধারণ পুরুষদের জন্য যৌনতার খরচ বাড়িয়ে দেবে। ফলে সাধারণ পুরুষদের একটা বড়ো অংশ মহিলাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দেওয়া বন্ধ করার পক্ষে থাকে (আফগান পদ্ধতি বা মার্কিন বাইবেল বেল্ট পদ্ধতি), আবার অনেকে মহিলাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিয়ে যৌন স্বাধীনতা না দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেন (ইরানী পদ্ধতি)। তারা ধর্মকে সামনে রেখে চরম বাম বিরোধিতায় লিপ্ত হচ্ছে। পশ্চীম বিশ্বে শ্বেতাঙ্গবাদী ও খ্রিশ্চান রাজনীতির মধ্য দিয়ে লিঙ্গ ও সংখ্যালঘু রাজনিতির বিরোধিতা শুরু হয়েছে। আর মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলোয় ইসলামকে সামনে রেখে লিঙ্গ ও সংখ্যালঘু রাজনিতির বিরোধিতা চলছে। শিল্পোন্নত পূর্ব এশিয়ায় সাধারণ পুরুষদের জন্য যৌনতার খরচ কমানোর জন্য সেক্স রোবট, ভার্চুয়াল সেক্স, একক পিতৃত্ব, স্বয়ংক্রিয় গর্ভ, সারোগেসি, ইত্যাদি ব্যবস্থা করার চেষ্টা চলছে (চীনা পদ্ধতি)।

বাংলাদেশে লুটেরা বাণিয়া পুঁজি ও ভারতীয় আধিপত্যবাদ কিভাবে বামদের ব্যবহার করে?

বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই লুটেরা-বাণিয়া পুঁজি দ্বারা শাসিত। এই শাসক শ্রেণি আবার ভারতীয় আধিপত্যবাদের মিত্র। এর বিরুদ্ধে ২০২৪-এর ৫ই অগাস্ট ঘটে গেছে উৎপাদক পুঁজি-মধ্যবিত্ত-শ্রমিকের বিপ্লব। কিন্তু এই সামাজিক শ্রেণিগুলো দুর্বল হওয়ায় লুটেরা-বাণিয়া পুঁজিকে এখনো পর্যন্ত উচ্ছ্বেদ করতে পারেনি বিপ্লবী শক্তি। বলা বাহুল্য ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও বাংলাদেশের লুটেরা বাণিয়া পুঁজি সবসময় বামেদের "কিছু কর" মানসিকতা কাজে লাগিয়ে সমাজকে নারী সংখ্যালঘু কেন্দ্রীক রাজনীতি উসকে দিয়েছে এবং সামাজিকভাবে ইসলামপন্থীদের কোণঠাসা করার চেষ্টায় লীপ্ত থেকেছে। ৫ই অগাস্ট বিপ্লবের পরে বিপ্লবী নেতা মাহফুজ আলম বলেছিলেন বাম ও ইস্লামপন্থীদের দ্বন্দ্ব শেষ হয়েছে। বিপ্লবীরা বাম ও ইস্লামপন্থীদের নিয়ে এক ধরণের মধ্যপন্থী রাজনীতি তৈরির চেষ্টা করেছিল। কিন্তু "ধর্ষণ মঞ্চ" থেকে বিপ্লব বিরোধিতায় যেভাবে বামপন্থীরা যেভাবে মেতে ওঠে তাতে এটা পরিস্কার যে বাম-ইসলামপন্থী মিলন হয়নি। আর তাই বলাই যায় মাহফুজের ও বিপ্লবীদের তথাকথিত মধ্যপন্থী রাজনীতি ব্যর্থ হয়েছে।

এবার প্রশ্ন বাংলাদেশের মধ্যপন্থী বিপ্লবীরা ব্যর্থ হল কেন?

এর কারণ বস্তুগত দিকে দিয়ে তারা বাম ও ইসলামপন্থীদের অবস্থান বিচার করেনি। মাহফুজ আলম বলেন যে ভাষা দিয়ে বাম ও ইস্লামপন্থীদের তিনি এক জায়গায় এনেছেন। এখানেই ভুল হয়েছে। ভাষা দিয়ে ওপর ওপর এক হয়েছিল কেবল শত্রু এক হওয়াতে অর্থাৎ হাসিনা আওয়ামী ভারত- সেখানে ঐক্যকরণের কাজটা করেছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে বামেরা যেহেতু কৃষক শ্রমিক-কে কেন্দ্র করে বর্তমানে রাজনীতি করতে পারছেনা, তারা নারী ও সংখ্যালঘু কেন্দ্রীক রাজনীতিতে চলে যেতে বাধ্য। এবং বামেদের "কিছু কর" মানসিকতা কাজে লাগিয়ে লুটেরা-বাণিয়া পুঁজি ও ভারতীয় আধিপত্যবাদ সেই নারী ও সংখ্যালঘু বিষয়কে অহেতুক সামনে এনে ইসলাম্পন্থীদের কোণঠাসা করা শুরু করবে এবং করছে। ফলে বাম বনাম ইসলামপন্থী আবারও ফিরে এসেছে এবং মধ্যপন্থী বিপ্লবীরা ব্যর্থ হয়েছে।

দুই প্রতিকারঃ সামাজিক উদ্যোগ ও পুরুষের যৌনতা পাওয়ার খরচ কমানো

এই সমস্যাকে দুভাবে সামলাতে হবে। এক, রাজনীতিকে উৎপাদন মুখী করতে হবে। মহম্মদ ইউনূস-এর সামাজিক ব্যবসা-কে সামনে রেখে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। মানুষ উৎপাদন মুখী চিন্তা করলেই কেবল তোলাবাজী, ঘুষ ও মজুতদারী বিরোধী রাজনীতি তৈরি হবে। বিংশ শতকের সত্তর দশক অবধি যে শ্রমিক শ্রেণি ছিল অথবা উনবিংশ ও অষ্টাদশ শতকে যে উৎপাদক মধ্যবিত্ত পুঁজি (ফরাসী ভাষায় বুর্জোয়া) ছিল তা আজ অনুপস্থিত। তাই ইউনূস সাহেবের সামাজিক উদ্যোগকে সামনে রেখেই উৎপাদন মুখী রাজনীতি গড়ে তুলতে হবে। ইউনূস সাহেব নিজেও বাংলাদেশের যুবকদের উদ্যেশ্যে সামাজিক উদ্যোগের আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান। ইউনূস স্যার জানেন যে উৎপাদন মুখী রাজনীতি করতে হবে আর তাই তিনি "ছাত্র জনতা"র বিপ্লবকে "ছাত্র শ্রমিক জনতা"র বিপ্লব বলে চিহ্নিত করেন। দুই, নারীর যৌন স্বাধীনতার ফলে সাধারণ পুরুষের কাছে যৌনতা পাওয়ার (সঙ্গিনী পাওয়া বা বিয়ে করার) খরচ যে বেড়ে যায় সেই ব্যপারে ওয়াকিবহাল হওয়া এবং সেই খরচ কমাবার উদ্যোগ গ্রহণ করা। উন্নয়নের সাথে সাথে বিয়ের বয়স বেড়ে যায় আর এই সমস্যা প্রতিকারে বাংলাদেশের ছাত্র নেতা সারজিস আলম-এর ভালো লেখাও ছিল ফেসবুকে। এরকম উদ্ভাবনী চিন্তা করতে হবে। বাংলাদেশে কাবিন নিয়ে দর কষাকষি যেভাবে চলে তা বুঝে কাবিন যাতে ব্যবসায় পরিণত না হয় সেরকম আইন আনা। ধর্ষণের কড়া শাস্তির পাশাপাশি মিথ্যে ধর্ষণ মামলা করাও যেন কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ হয়।

সুতরাং সামাজিক উদ্যোগ-এর আন্দোলন ও পুরুষের যৌনতা পাওয়ার খরচ কমানোর নীতি নিলে অবশ্যই লুটেরা বাণিয়া পুঁজি ও ভারতীয় আধিপত্যবাদকে পরাজিত করা সম্ভব।

Author: Saikat Bhattacharya


You may also like