
আমি মনে করি মানব সভ্যতা এগিয়ে চলেছে আর এগিয়ে চলার পথে নতুন নতুন বিষয় যুক্ত হচ্ছে এবং বাদ চলে যাচ্ছে। তাই বর্তমান পুরুষাধিকার আন্দোলনকে ঐতিহাসিক পটভূমিকায় ব্যখ্যা করা দরকার বলে আমি মনে করি। আমি ফ্রেড্রিক এঙ্গেলস-এর "ওরিজিন অফ দ্য ফ্যামিলি, প্রাইভেট প্রপার্টি আয়াণ্ড দ্য স্টেট" ও গের্দা লার্নার-এর "দ্য ক্রিয়েশন অফ প্যাট্রিয়ারকি" নামক দুই বিখ্যাত বই-এর লেখা ও ব্যখ্যা অনুসারেই এগোব। আমি আমার লেখাকে পাঁচ ভাগে ভাগ করেছি। প্রথমে আদীম সমাজ, দ্বিতীয় ভাগে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ, তৃতীয় ভাগে বর্তমান সমাজ (আধুনিক সমাজ ইচ্ছে করেই ব্যবহার করা হয়নি কারণ ষোড়শ শতক থেকে উনবিংশ শতকের প্রথম ৭০ বছর পর্যন্ত আধুনিক সমাজে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের গুণগুলোই বেশি করে লক্ষ্য করা গেছে), চতুর্থত ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পুরুষাধিকার আন্দোলনের দাবিগুলো ব্যখ্যা করা এবং শেষে সেই দাবির সমর্থনে আমরা দেখিয়েছি দুনিয়া জুড়ে কিভাবে বিবাহ নামে প্রতিষ্ঠানটা অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে।
আদীম সমাজ
মানুষ আদীম যুগে লিঙ্গ ভিত্তিক শ্রমের বিভাজন করে।এর কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল একজন পুরুষ মারা গেলে জন্মহারের ক্ষতি কম হয় কিন্তু একজন নারী মারা গেলে জন্মহারের ক্ষতি বেশি হয়। একটা সমাজে কম সংখ্যায় পুরুষ ও বেশি সংখ্যায় নারী থাকলে সেই সমাজ বছর শেষে বেশি সন্তান দেবে আর অন্যদিকে বেশি সংখ্যক পুরুষ ও কম সংখ্যক নারী থাকলে একটা সমাজ বছর শেষে কম বাচ্চা দেবে। অর্থাৎ জন্মহার বেশি রাখতে গেলে নারীর জীবনের মূল্য পুরুষের থেকে বেশি হতে হবে সমাজে। এর একটা প্রভাব যা আজও আমরা বহন করে চলেছি তা হল নারীর কান্নায় সমাজ কষ্ট পায় আর পুরুষের কান্নায় সমাজ হাঁসে। এর আরেকটা প্রভাব হল পুরুষের বহুগামীতাকে নারীর বহুগামীতার থেকে জন্মহার বাড়ানোর পক্ষে বেশি কার্যকরী বলে মনে করা।
মহামারী, পশুর আক্রমণ, পোকামকড়ের কামড়, ফলের বিষ, আবহাওয়া, পরিবেশ, ইত্যাদি অনেক মৃত্যু ডেকে আনত আদীম সমাজে। তাই জন্মহার খুব বেশি রাখতেই হত। তাই নারীকে বাচ্চা দেওয়া, বাচ্চা লালন করা ও সবজি ফল কুড়োনোর মতো কাজ দেওয়া হয় যেখানে মৃত্যুর সম্ভাবনা কম। আর পুরুষকে দেওয়া হল শিকার ও যুদ্ধের কাজ যেখানে মৃত্যুর সম্ভাবনা খুব বেশি।
কিন্তু পুরুষ এই কঠিন কাজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করে কি পাবে? তাই আদীম সমাজ পুরুষকে যৌন অধিকার দেয়।
পুরুষ প্রতিদিনের যৌন অধিকার পেয়েই খুশি ছিল। সে নারীর গর্ভে তার সন্তান এল কি না, তা নিয়ে চিন্তিত ছিলনা।
সমস্ত পুরুষ সমাজের সমস্ত নারীর সাথেই যৌনাচার করতে পারত। ফারটাইল উইন্ডোর ৬ দিনের মধ্যেও একজন নারী একাধিক পুরুষের সাথে যৌনাচার করত। ফলে বাবা কে তা জানা যেতনা। মাতৃ পরিচয়ে বড় হত সন্তান।
এছাড়াও শিকাড়ি যোদ্ধা পুরুষ একরকমভাবে চিন্তা করত এবং কোড়ানো ও বাচ্চার দেখাশুনা করা নারী অন্যরকমভাবে চিন্তা করত। ফলে মানসিক গতিও তাদের আলাদা হয়ে যায়। এই আদীম যুগ লক্ষ্য লক্ষ্য বছর ধরে চলেছে।
পিতৃতান্ত্রিক সমাজ
আস্তে আস্তে মানুষ গবাদী পশু পালন ও কৃষি শেখে। তারপরে তৈরি হয় ছোট ছোট হস্তশিল্প। শুরু হয় বাণিজ্য। শেষে এক সময় গবাদী পশু ও জমি কেন্দ্রিক ব্যক্তি মালিকানা তৈরি হয়। দূর দুরান্তরে গিয়ে যুদ্ধ ও ব্যবসা পুরুষ করতো বলে পুরুষের হাতেই ব্যক্তি মালিকানা চলে আসে। সেই অর্জিত মালিকানা নিজের ঔরসজাত সন্তানকেই দিতে পুরুষ উদ্যত হয়। তাই নারীর গর্ভ-এর ওপর একচেটিয়া অধিকার চায় ব্যক্তি মালিক পুরুষ। এভাবেই আজকের স্বামী-স্ত্রীর সংসার তৈরি হয়। পুরুষ রোজগার করে আর নারী সেই রোজগারের ওপর নির্ভরশীল।
এছাড়াও আরেকটা বিষয় হল কৃষি ও গবাদী পশু পালন কেন্দ্রিক অর্থনীতিতে খুব অল্প বয়সেই একজন মানুষকে উৎপাদনকারী কাজে যুক্ত করা যায় যেমন বীজ মাটিতে পোঁতা, ফসলের পরিচর্যা করা, ফসলকে নির্দিষ্ট স্থানে সঞ্চিত করা, গবাদী পশু চড়ানো এবং তাদের দেখাশুনা করা। ফলে বাচ্চার জন্মের ১২ বছরের মধ্যেই তাদের উৎপাদনশীল বানিয়ে ফেলা সম্ভব হয়ে উঠল। তাই উচ্চ জন্মহার আরও লাভজনক হয়ে উঠল। ফলে নারীকে আরও বেশি করে সন্তান ধারণ ও লালন করার কাজে নিযুক্ত করা হতে লাগল এবং অন্যান্য অধিকাংশ কাজই পুরুষের আওতায় চলে যেতে লাগল।
পুরুষ নারীর বাচ্চা দেওয়া ও বাচ্চা-সংসার দেখাশুনার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু যদি পুরুষ রোজগার বেশি করে তাহলে পুরুষ অন্য স্ত্রী আনতে পারে। আর তাই উচ্চ রোজগারের পুরুষ স্বাভাবিকভাবে স্ত্রীর থেকে বেশি ক্ষমতাবান ছিল। কম রোজগারের পুরুষকে সেদিনও মানিয়েই চলতে হত স্ত্রীর সঙ্গে। এভাবেই শুরু হল পিতৃতান্ত্রিক সমাজ যা চলে হাজার হাজার বছর ধরে।
বর্তমান সমাজ
শিল্প বিপ্লবের ১০০ বছর পরে উনবিংশ শতকের শেষের দিকে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। একদিকে জীবন দায়ী ওষুধ আবিষ্কারের ফলে মহামারী, ক্ষরা, বন্যাজাত মৃত্যুর হার কমতে শুরু করে। আবার অন্যদিকে শিল্পোন্নত সমাজে সন্তানকে বড়ো করার খরচ অনেক বেড়ে যায়। স্কুল কলেজ পাঠিয়ে সন্তানকে রোজগারের উপযোগী করার জন্য অনেক সময় ব্যয় করতে হয় আর তাই সন্তানের রোজগেরে হতে হতে বয়স অনেক বেড়ে যায়। এই দুই-এর প্রভাবে জন্ম হার কমাতে বাধ্য হয় সমাজ কারণ বেশি সন্তান হয়ে যায় দায়।
কম সন্তানই ভাল আর তাই নারীর হাতে চলে আসে শ্রম বাজারে ঢোকার মতো পর্যাপ্ত সময়। কম সন্তান দিতে হচ্ছে বলে নারী পড়াশুনা অনেক বয়স অবধি করে বিয়ে করতে পারছিল। কম বাচ্চা মানুষ করতে হচ্ছিল বলে নারীর হাতে অনেকটা সময় থেকে যায়। ফলে নারী শ্রম বাজারে ঢুকতে শুরু করে। দুনিয়া জুড়ে শিল্পোন্নয়ন যত বাড়তে থাকে এই প্রবণতা বাড়তে থাকে। নারীকে শ্রম বাজারমুখী করতে পারলে সরকার দেখল যে জন্মহারও কমছে আবার শিল্পন্নয়নের গতিও বাড়ছে। ফলে সরকার আরও বেশি নারীকে শ্রম বাজারে আনার চেষ্টা করতে থাকে। ফল দাঁড়ায় নারী রোজগেরে হোয়ে ওঠে। রোজগেরে নারী স্বামীর কথা মেনে চলতে বাধ্য নয়। সরকারও পিতৃতান্ত্রিক অধিকারগুলো পুরুষের কাছ থেকে কেড়ে নিতে থাকে। আইন ও নারীর রোজগার শেষমেশ পুরুষের কাছে বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটাকে অলাভজনক করে ফেলে।
পুরুষাধিকার আন্দোলনের দাবি
এখন আমাদের মতো পুরুষধিকার কর্মীরা এটা বলেনা যে পুরুষের পুরনো পিতৃতান্ত্রিক অধিকারগুলো ফেরত দাও।
আমরা প্রশ্ন করি যে পুরনো অধিকারগুলো যখন পুরুষের নেই, পুরুষ আর পুরনো কর্তব্যই বা পালন করবে কেন? জন্মহার বেশি রাখতে গেলে নারীর জীবনের মূল্য পুরুষের থেকে বেশি হতে হবে। কিন্তু আজ যখন বেশি সন্তান দায়, আর তাই বেশি জন্মহারের দরকার নেই, তখন পুরুষের প্রাণের মূল্য নারীর প্রাণের মূল্যের সমান করতে হবে।
আদীম সমাজ পুরুষকে কঠিন কাজ করতে বলতো বটে কিন্তু বদলে যৌন অধিকার দিত। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ পুরুষকে সংসারের জন্য রোজগার করার আর দেশের জন্য যুদ্ধে যাওয়ার কর্তব্য শিখিয়েছে কিন্তু বদলে দিয়েছে যৌন অধিকার এবং স্ত্রীর গর্ভে কেবল নিজের ঔরসজাত সন্তান পাওয়ার অধিকার।
বর্তমান সমাজ পুরুষের অধিকার কেড়ে নিয়েছে বটে কিন্তু পুরনো কর্তব্যগুলো পালন করতে বলে চলেছে। তাই দলিয় রাজনীতি হোক বা যুদ্ধ পুরুষকেই মরতে পাঠানো হচ্ছে আর ডিভোর্স হলে স্বামীকে দিতে হচ্ছে খোরপোষ। অথচ স্ত্রী স্বামীর কথায় যৌনতা দিতে বাধ্য নয়। এমনকি পরকিয়া করলেও স্বামীর কিছু করার নেই।
এরকম চলতে পারেনা। পুরুষকে বিয়ে এবং প্রেম এড়িয়ে চলতে হবে। পুরুষকে যৌনতার বাজারকে উন্মুক্ত করার সংগ্রাম করতে হবে। যৌনতাকে বেশি বেশি করে চুক্তিভিত্তিক ও পণ্যায়িত করতে হবে।
পুরুষকে নিজের জন্য বাঁচা শিখতে হবে, নিজের জন্য খরচ করা শিখতে হবে এবং জীবনকে একা উপভোগ করা শিখতে হবে। প্রযুক্তি ও সমাজের গতি বলছে আমরা জিতব।
পশ্চীম, চীন, জাপান, কোরিয়া, রাশিয়াঃ সর্বত্র বিয়ে কমছে, ভারতেও তাই হোক
আগে নারী ঘরের কাজ করত। পুরুষ বাইরের কাজ করত। দুজনেরই দুজনকে দরকার ছিল। আজ পুরুষ রোজগার করছে, আবার রাধতেও জানে। নারী আজ রাধতেও জানে, আবার রোজগারও করে। এখন সুন্ধরী মহিলারা মডেল বা অভিনেত্রি বা সোস্যাল মিডিয়ার স্টার হতে চায়। এই চাওয়ায় কোন ভুল নেই কারণ এটা তাদের অর্থনৈতিক অধিকার। সাধারণ দেখতে যে মেয়েরা আছে, তাদের বিয়ে করার কথা ভাবতে ভাবতে ৩০ পেরিয়ে যাচ্ছে, কারণ নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তবেই তারা বিয়ে করবে। এই ভাবনাতেও কোন ভুল নেই কারণ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সবাই চায়। তো আজ একজন রোজগেরে রাঁধতে জানা মধ্যবিত্ত ও নীম্নবিত্ত পুরুষের খামোখা একজন নারীকে বিয়ে করে লাভ কি? সে সাধারণ মানের নারী পাচ্ছে যার শ্রেষ্ঠ সময়টাই চলে গেছে।
শেষ জীবনে নিজের একটা মাত্র সন্তান কোন বিদেশে থাকবে কেউ জানেনা। কাছে থাকলেও দেখাশুনা করবে এমন কথা নেই। তার ওপর প্রচণ্ড রকম নারী কেন্দ্রিক আইন ব্যবস্থা যার ফলে সামান্য ঝামেলায় বড় ফাসান ফাঁসতে হতে পারে পুরুষকে। স্ত্রী এখন স্বামীকে যৌনতা দিতেও বাধ্য নয়, স্ত্রী-এর ইচ্ছের ওপর স্বামীর যৌন স্বাধীনতা বর্তমানে নির্ভরশীল। তাই বলাই যায় বিয়ে পুরুষের জন্য খুবই অলাভজনক। মধ্যবিত্ত ও নীম্নবিত্ত পুরুষের অবশ্যই বিয়ে এড়িয়ে যাওয়া দরকার। একা একা জীবনকে উপভোগ করতে শেখা দরকার।
ধনি পুরুষ হলে, সুন্দরী স্ত্রী পেতে পারে এবং তার উত্তরাধিকারীর দরকার হবে সম্পত্তি দেখাশুনা করার জন্য। আইনী ঝামেলা থেকে নিজেকে উদ্ধারও করতে পারবে সে। সে নিজের দায়ে বিয়ে করতে পারে। কিন্তু মধ্যবিত্ত ও নীম্নবিত্ত পুরুষের সেই সুযোগ নেই। তারা বিয়ে না করে নিজের জীবনটা উপভোগ করুক। সংসারের হ্যাপা না থাকলে অনেক সৃষ্টিশীল কাজে মন দিতে পারবে পুরুষ, হয়তো নারীও পারবে। বিবাহ নামের প্রতিষ্ঠানটা টিকিয়ে রাখা বোকামী।
রোমান্স-এর গল্প আজ অচল। ১৬ বছর বয়স থেকেই এখন নারী ও পুরুষ একাধিক সম্পর্কে লীপ্ত হচ্ছে। শেষে ৩০-এর বেশি বয়সে এসে বিয়ে করছে। স্ত্রী বা স্বামীকে নিয়ে রোমান্টিকতার জায়গাটা আর নেই। একাকিত্বের একটা ভয় থাকে মানুষের। বা সামাজিক চাপ থাকে। এই দুই-এর ভয় বিয়েটা ভারতে এখনো হচ্ছে। তবে পশ্চীমে, চী্নে, জাপা্নে, রাশিয়াতে বিয়ে কমছে। কমবেই। আজকের বাস্তবতা হল স্ত্রী তার স্বামীর প্রথম প্রেম নয় আর স্বামী তার স্ত্রীর প্রথম পুরুষ নয়। রোমান্সের এতটুকুও জায়গা নেই আর। শুধু একাকিত্বের ভয় ও সামাজিক চাপে বিয়ে করার ফল হয় গোটা জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে আর অনেক ব্যক্তির সৃষ্টিশীলতা ধ্বংস হয়।
একা থাকাকে উপভোগ করা একটা আর্ট। এই আর্ট না জানলে মানুষ সৃষ্টিশীল হয়না। ব্যক্তিগতভাবে আত্মবিশ্বাসী মানুষ সামাজিক চাপ উপেক্ষা করেই যে কোন কাজ করে। ভারতের মানুষ যত বেশি আত্মবিশ্বাসী ও সৃজনশীল হয়ে উঠবে ততই উন্নত হবে এবং উন্নত দেশগুলোর মতো বিয়েও কমবে।
Author: Saikat Bhattacharya