feminism

কেন বাঙালী নারীবাদী হয়


ভারতে বসবাসরত বাঙালী যে নারীবাদের শীর্ষ পদক নেবে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ভারতীয় বাঙালীর নারীবাদ ধর্মীয় মৌলবাদের মতোই উগ্র ও অন্ধ। নারীবাদ বাঙালীর মজ্জাতেই ঢুকে গেছে নানাকারণে। কিন্তু কীভাবে তা হল সেটার বিশ্লেষণ তেমন সঠিকভাবে হয়নি। এই লেখনীতে সেই বিশ্লেষণই করব যে কীকরে এমনটি হল এবং কেন বাঙালী এই বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হল।

প্রথমেই বলে নিই এখানে বাঙালী বলতে গড়পড়তা ভারতীয় বাঙালীর কথা বলা হচ্ছে। ব্যাতিক্রম বা বাংলার সোনালী যুগের শাসক, অভিজাত থেকে শুরু করে creme la creme বাঙালীর কথা বলা হচ্ছেনা। গৌড়েশ্বর শশাঙ্ক থেকে বাংলার শেষ সার্বভৌম বাদশা দাউদ খান কররানী পর্যন্ত যে হাজার বছরের গরিমার সময়, তখনকার বাঙালী এমনটা ছিলনা। সাধারণ বাঙালী তা হয়ে থাকতে পারে কিন্তু কুলীন creme la creme শ্রেণী এরকম ছিলনা। তারা সকলেই পৌরুষবলে বলীয়ান ছিলেন এবং আজকের বাঙালীর সাথে তাদের তুলনাই চলেনা। তারও আগে সিংহবাহুর শাসনামলে বা চন্দ্রবংশের সময়েও বাঙালী এইরম ছিলনা।

মূলত বাঙালী যখন 1576 এ সার্বভৌমত্ব হারিয়ে ফেলল তখন থেকেই এরম অবক্ষয় হয় বাঙালীর যেটা ব্রিটিশশাসনামলে ও ভারতরাষ্ট্রে তার ষোলকলা পূর্ণ হয়।

একটা মুখ্য বিষয় মনে রাখতে হবে যে নারীবাদ বৈশ্বিকভাবে সংগঠিত হয় 1960 এর দশক থেকে ও বিশ্বের পরাশক্তির মদতেই তা গোটা বিশ্বে ছড়ায়। কিন্তু বাঙালীর নারীবাদের সঙ্গে এর সম্পর্ক খুববেশী হলে অনুঘটকের মতো, তার বেশী নয়। বাঙালীর নারীবাদ বাঙালীর মধ্যেই বহুদিন ধরে চুড়ান্তভাবে ছিল। এটা এখানকার সংস্কৃতির মধ্যেই আছে।

আমারা যদি বাংলা সাহিত্য থেকে সনাতনী বাঙালীর সংখ্যাগরিষ্ঠ শাক্ত্যমত দেখি তাহলে দেখতে পাব যে সবখানেই আমরা নারীকেন্দ্রিকতা ও পুরুষবিদ্বেষ দেখব। শাক্ত্যমতে দৈবশক্তিই হল নারীশক্তি, তাই সেই মতে নারীর স্থান সবসময়েই পুরুষের উচ্চে। শাক্তমতে আরাধ্যরা সকলেই দেবী ও তার বিপরীতে অসুর-দানবরা হল পুরুষ। এখানে শুভশক্তি মাত্রেই নারী ও অশুভশক্তি মাত্রেই পুরুষ এই প্যারাডাইম তৈরী হয়। ফলে এর থেকে যে বিশ্বাসটি জন্ম নেয় যে নারী মানেই সে কোন মানুষ নয়, সে পূজনীয় দৈবসত্তা(divine entity) আর পুরুষ মাত্রেই সে অশুভ আসুরিক শক্তির প্রতীক। এইভাবে গড়পড়তা বাঙালীর মাঝে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে পড়ে।

স্বাধীন বাঙালী রাষ্ট্রের পতনের সাথে এই ধারণাই মূলধারার বাঙালী চিন্তার মধ্যে আসে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য স্বাধীন বাঙালী শাসক কেউ শাক্ত্য ছিলেননা। তারা মূলত বৌদ্ধ, শৈব, বৈষ্ণব ও মুসলমান ছিলেন। তাই নারীপূজা বাঙালীর ঐতিহ্য বলে যে অপপ্রচার করা হচ্ছে সেটাও হল এপ্রকার নারীবাদী প্রোপাগাণ্ডা।

এবার দেখে নেওয়া যাক যে ধর্মের বিবর্তনের নিরীখে এইধরণের ধর্মীয় আচারের স্থান কীরূপ। নারীপূজার প্রাধান্য, মাতৃকাপূজা এর উদ্ভব হয় নিওলিথিক যুগে এবং ব্রোঞ্জযুগ পর্যন্ত ইহা ছিল। মূলত নগরসভ্যতা ও লৌহযুগের বিকাশের সাথেই ইহার সমাপ্তি ঘটে। মানুষ যখন শিকারী-সংগ্রাহক জীবন ছেড়ে সবে কৃষিকাজে ঢুকেছে তখন জমির উর্বরতা ও নারীর উর্বরতাকে এক করে মাতৃকাশক্তি রূপে পূজা করা হত। এইসময়ের সমাজ ছিল নারীতান্ত্রিক। ইউরোপ থেকে আনাতোলিয়া সর্বত্রই নিওলিথিক থেকে মধ্য ব্রোঞ্জযুগ পর্যন্ত এইধরণের মাতৃতান্ত্রিক সমাজের উদাহরণ পাওয়া যায়। নগরসভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে মূলত পুরুষদেবতাপ্রধান পৌত্তলিকধর্মের সূচনা হয় ও লৌহযুগ বিকাশের সাথে একেশ্বরবাদ ও পিতৃতন্ত্রের বিকাশ ঘটে।

এর থেকে কতগুলো জিনিস পরিষ্কার হল। এক, বাঙালীর বিবর্তন তাম্রযুগ অবধি। লৌহযুগের বিকাশ ঘটেনি, নগরসভ্যতারও বিকাশ ঘটেনি। Richard Eaton এর Rise of Islam in Bengal Frontier গ্রন্থে বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করা আছে যে কীভাবে ইসলামের আগমনের পরে বাংলার বিস্তীর্ণ জলাজঙ্গলভূমি পরিষ্কার করে জনবসতির বিস্তার হয়। অর্থাৎ ইসলামের আগমনের পূর্বে লৌহযুগের এই বুনিয়াদী ধাপের বিকাশ হয়নি। জনসংখ্যার বিস্তারও আগের মতন ঘটেনি।

যদি বাঙালী সাহিত্য দেখা যায় সেখানেও দেখব যে নারী মানেই সে মহীয়সী আর অত্যাচারিত আর পুরুষ মানেই যত খারাপের ডিপো। এটাই বাংলা সাহিত্যের অন্যতম মূল থিম। পুরুষ স্বাধীন জীবনযাপন করলে সেটা অন্যায় আর নারী করলে সেটা সমাজবিপ্লব। এই হল গড়পড়তা শিক্ষিত বাঙালীর মনন।

ব্রিটিশ আমল থেকে বাবু-কেরানী চাকুরীজীবী শ্রেণী উলুবনে শেয়ালরাজা হয়ে বসে এবং এরাই বাঙালী সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে। এরা সবসময়েই বাঙালীকে স্তাবকতা, দাসবৃত্তি শিখিয়েছে এবং নিজেরা উলুবনে শেয়ালরাজা হয়ে থাকার জন্য বাকী বাঙালীদের শেষ করেছে।

যেহেতু এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীটাই বাঙালীকে নিয়ন্ত্রণ করে তাই এদের বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে। মধ্যবিত্ত বাঙালীর কাছে সবকিছুই খরচ। যেহেতু তাম্রযুগের আগে বিবর্তন হয়নি তাই বাণিজ্য, বিনিয়োগ, উৎপাদন এসব রপ্ত করতে পারেনি। তাই বাঙালী মধ্যবিত্ত subsistance mindset এ চলে। আবার যেহেতু এরা চাকুরীজীবী তাই সর্বদাই পরনির্ভর। পূর্বপুরুষের সম্পত্তিও হাতছাড়া করেছে এবং যৌথপরিবার ধ্বংস করে নিউক্লিয়ার পরিবার গড়েছে। সবকিছুর ফলে এরা সন্তানকেও খরচা ও বোঝা হিসাবেই দেখে, স্বাভাবিক জৈবিক  অপত্যস্নেহ ও বংশবিস্তারের আকাঙ্খাও জন্মায়নি এদের মধ্যে। এছাড়াও গড়পড়তা বাঙালী হয় প্রচণ্ড ভীতু, ঝুঁকিবিমুখ, স্বার্থপর ও ঈর্ষাকাতর। ফলে ইহারা সন্তানদেরকে নিজেদের স্বার্থের মাঝেই দেখে, তাদের পূর্ণাঙ্গ মানব হিসাবে স্বীকৃতি দেয়না। তাদের মাঝে এই মনস্তত্ব কাজ করে যে কন্যাসন্তানকে বিয়ে দিয়ে অপর কারুর ঘাড়ে চালান করে দেব ও পুত্রসন্তানকে গবাদীপশুর মতন কলুর বলদ বানাবো যাতে বৃদ্ধবয়সের পেনসন হতে পারে সে। বাঙালী পুত্রসন্তান মানুষ করে বৃদ্ধ বয়সের পেনসন হিসাবে ও কলুর বলদ হিসাবে।

এইকারণে জন্ম থেকেই কন্যাসন্তানের জন্যে খোলা ছুট থাকে যাতে সে কোন মালদার পার্টি পাকড়াও করতে পারে আর পুত্রসন্তানকে পুরো শিকলবদ্ধ গাভী করে বড় করে। তার জীবনের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা থেকে সর্বক্ষণ তার উপর অকথ্য অত্যাচার চলে তাকে একদম মেরুদণ্ডহীন ক্রীতদাস বানানোর জন্যে। ফলে সামাজিক জীবন থেকেও বঞ্চিত হয় ও জীবনের স্বাভাবিক চাহিদাও মেটেনা। এইকারণে প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থাতেও তারা ভেড়ুয়া, ভীতুতে পরিণত হয় ও পদে পদে ঝাড় খায়। তাছাড়াও বাঙালী উলুবনে শেয়ালরাজা হতে চায়, ফলে বাকীরা একদম ভেড়ুয়া না হলে সেটা সম্ভব নয়। তাই বাঙালী সমাজনেতারাও এইটাকে পৃষ্ঠপোষকতা করে।

বাঙালী পৌরুষকে ঘৃণা করে ও পুরষচরিত্রকে দমনের চেষ্টা করে। কারণ উপরোক্ত arrangement ধরে রাখতে এটা খুব দরকার। যদি বাঙালীর মধ্যে কোন পৌরুষসুলভ চরিত্রের বিকাশ ঘটে তাহলে উপরোক্ত সমস্তকিছুই বন্ধ হবে। সে মধ্যবিত্তের শাসনও মানবেনা, সে গোলামিও মেনে নেবেনা। দালাল ও তাবেদারদের রাজও চলে যাবে। বাঙালী শক্তিশালী ও ধনী জাতি হিসাবে পুনরায় উঠবে। তাই যারা এটা আটকাতে চায় তারাই বাঙালীকে নারীবাদী বানিয়েছে।

এইভাবে সংক্ষিপ্তভাবে বিশ্লেষণ করা গেল যে বাঙালী কেন নারীবাদী হয় এবং কীভাবে তা হল। পরবর্তী লেখনীগুলিতে আমি ঋরো বিস্তারিতভাবে এই আলোচনা করব এবং এর থেকে বেরনোর পথও লিপিবদ্ধ করব।

শেষে একটা কথা বলে নেই, রাজনৈতিক সঠিকতা অর্থাৎ political correctness থাকলে এই পথে আসার দরকার নেই। প্রচলিত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লড়ার প্রথম শর্তই হল অকপট সত্যিটা সামনে তুলে ধরতে হবে। তাই আমি কোন রাখঢাক না রেখেই সত্য বলে চলব তাতে কে কী ভাবল তোয়াক্কা না করে। সত্যের জয় হোক

Author: Purandhar Khilji


You may also like