একবিংশ শতাব্দীর পুঁজিবাদ বিরোধী সংগ্রাম কেমন হবে

12-November-2021 by east is rising 326

ভূমিকা

আমরা শেষ দুটো লেখায় যা বলতে চেয়েছিলাম তার সারমর্ম হল চীনের উত্থান বিশ্ব অর্থনীতির ভারসাম্য বদলে দিয়েছে এবং এর ফলে মার্কিন সামরিক আধিপত্য মুনাফা ও বাজারের পক্ষে সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর স্বাভাবিক পরিণতি হচ্ছে বিশ্ব-ভূরাজনীতিতে অস্থির অবস্থা। বিংশ শতাব্দীর সূচনাতে জার্মানি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্থান ঠিক যেভাবে ব্রিটিশ কেন্দ্রিক ভূ-রাজনীতিকে টলিয়ে দিয়েছিল, আজ চীনের উত্থানও একইভাবে মার্কিন কেন্দ্রিক ভূ-রাজনীতিকে টলিয়ে দিয়েছে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে অস্থির অবস্থাকে কাজে লাগিয়েছিলেন লেনিন, একইভাবে একবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ বহন করছে নতুন বিপ্লবের ইঙ্গিত। এই পরিস্থিতি কাজে লাগাতে গেলে আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি বুঝতে হবে, অতীত থেকে শিক্ষা নিতে হবে এবং তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এমন রাজনৈতিক মতাদর্শের ওপর বিপ্লবী সংগঠন দাঁড় করাতে হবে। আগের দুটো লেখায় আমরা বোঝার চেষ্টা করেছি বর্তমান পরিস্থিতি। এইবার আমরা বোঝার চেষ্টা করব অতীতের কিছু শিক্ষাকে। মাও-এর চিন্তাধারার ওপর দাঁড়িয়েই আমরা এই আলোচনা করব।  

মাও-এর চিন্তা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সোভিয়েত গোটা বিশ্বের কাছে আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণীর আদর্শ, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী পরাশক্তি ও দ্রুত শিল্পায়ণের রোল মডেল হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। সমাজতন্ত্র প্রচণ্ডভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সমগ্র বিশ্বে। স্তালিন এরকম সময়ে সমাজতান্ত্রিক সমাজের অর্থনৈতিক নিয়ম ব্যক্ষা করার চেষ্টা করেন “সোভিয়েতের অর্থনৈতিক সমস্যা” বইতে স্তালিনের মতে সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন পুজিবাদী উৎপাদন থেকে আলাদা একটি উৎপাদন ব্যাবস্থা। সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যাবস্থা মুনাফার উদ্যেশ্যে সংগঠিত হয়না বরং ব্যাবহার মূল্য মাথায় রেখে উৎপাদন করে। পণ্য, অর্থ, মূল্য, মজুরি, বেতন, ইত্যাদি রূপের দিক থেকে এক থাকলেও গুণের দিক থেকে আলাদা। বাজারের জন্য উৎপাদন না হয়ে পরিকল্পনা মতো উৎপাদন হয় বলে সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন পণ্য উৎপাদন (সম বিনিময় মূল্যের জন্য যে উৎপাদন হয়) নয়, তা দ্রব্য উৎপাদন মাত্রমাও স্তালিনের ভুলগুলো নিয়ে বিষদে আলোচনা করেন “সোভিয়েতে সমাজতান্ত্রিক সমস্যার ওপর নোট” নামক বইতেমাও ব্যক্ষা করেন যে পরিকল্পনা উপরিকাঠামোর (superstructure) অংশ কোন অর্থনৈতিক ভিত্তি (base) নয়। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ভিত্তি (base) হল পুঁজিবাদের মতোই পণ্য উৎপাদনঅর্থাৎ শ্রম অনুসারে প্রাপ্তি (payment according to ability)  হল সমাজতান্ত্রিক স্তরের বর্তমান অর্থনৈতিক ভিত্তি। এই ভিত্তি সম্পূর্ণ পুঁজিবাদী ভিত্তি। শুধুমাত্র উপরিকাঠামোর অংশ পরিকল্পিত অর্থনীতির মাধ্যমে এই পুঁজিবাদী ভিত্তি বদলানো যায়না। শ্রম অনুসারে প্রাপ্তি থেকে প্রয়োজন অনুসারে প্রাপ্তি-তে (payment according to needs)  উত্তরণ হওয়াই হল পুঁজিবাদ থেক কমিউনিস্ম-এ পৌছনো আর এই উত্তরণকালীন অধ্যায় হল সমাজতন্ত্র। মাও-এর মতে এই উত্তরণের জন্য দুটো শতকের লড়াই যথেষ্ট নয়। পুঁজিবাদ সামন্ততন্ত্রকে পরাজিত করে প্রতিষ্ঠিত হতে সময় নিয়েছে ছয় খানা শতক। তাই কেবল দুটো শতকের লড়াই (উনবংশ শতাব্দী ও বিংশ শতাব্দী) পুঁজিবাদ থেকে কমিউনিস্ম-এ উত্তরণের জন্য যথেষ্ট নয়। মাও ব্যক্ষা করেন যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ভিত্তি যেহেতু পুঁজিবাদী শ্রম অনুসারে প্রাপ্তি, সেইহেতু পুঁজিবাদী শক্তিগুলো অবশেষাত্বক ভাবে রয়ে যায়নি বরং অর্থনৈতিক ক্রিয়ার ফল হিসেবে পূর্ণ সজীবতা নিয়ে টিকে আছে। তাই পুঁজিবাদীরা পুনরায় ক্ষমতা দখল করার চেষ্টা চালাবে এবং বহু ক্ষেত্রেই সফল হবে। ঠিক সেভাবেই উৎপাদন শক্তি (production forces) ক্রমেই বেঁড়ে চলবে এবং পুঁজিবাদী সামাজিক সম্পর্কগুলোর সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব দেখা দিতেই থাকে। আর এই দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়েই কমিউনিস্টরা পুনরায় রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের চেষ্টা চালাবে এবং পরিস্থিতি অনুকূলে এলে সফলও হবে। এই লড়াই বহু শতাব্দী ধরে চলবে এবং প্রতিটি শতাব্দীর লড়াই আস্তে আস্তে আকাঙ্ক্ষিত কমিউনিস্ম-এর দিকে মানব সমাজকে নিয়ে যাবে। এই এগিয়ে চলার পথে অনেকবার জয় আসবে, অনেকবার পরাজয় আসবে, নতুন নতুন প্রতিষ্ঠানের জন্ম হবে, নতুন নতুন সমস্যা উঠে আসবে। বিশেষ সময়ে বিশেষ সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হওয়া ও বিশেষ সুযোগগুলোকে কাজে লাগিয়ে বিশেষ কিছু সাফল্য পাওয়াই হবে সেই বিশেষ সময়ের লক্ষ্য। তাই মাও-এর ব্যাক্ষা ধরে বলা যায় একবিংশ শতাব্দীতে মার্কিন সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ায় যে সুযোগ তৈরি হয়েছে তা দিয়ে সম্পূর্ণ কমিউনিস্ম পাওয়া যাবে এমনটা নয়। কিন্তু এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কমিউনিস্ম-এর লক্ষ্যে আরেক ধাপ এগোনো অবশ্যই যাবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সমস্যা ও সুযোগগুলো কি কি তা ঠিকমতো বুঝতে পারলেই আমরা বুঝতে পারব যে কতটা পথ এগোনো যাবে। মাও-এর এই শিক্ষা হৃদয়ঙ্গম করার জন্য আমরা এখন আলোচনা করব যে কিভাবে পুঁজিবাদ ছয় শতাব্দী ধরে লড়াই করে ধাপে ধাপে বিজয়ী হয়েছে।   

Author: Saikat Bhattacharya


You may also like