
ইতিহাস ও নৈসর্গের এক মনোরম সহাবস্থান হল গড় পঞ্চকোট। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের সাথে সাথে জীবন্ত ইতিহাসেরও সাক্ষী এই স্থানটি। পশ্চিমবাংলার পুরুলিয়া জেলার পাঞ্চেত পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এই স্থান। বরাকর বা আদ্রা থেকে সড়কপথে যাওয়া যায় এখানে।
জনস্রুতি অনুসারে দামোদার শিখর আনুমানিক নব্বই খ্রীষ্টাব্দে পাঁচজন উপজাতি সর্দারের সহায়তায় ঝালদাতে এই রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকে এই রাজ্যের নামকরণ হয় পঞ্চকোট অর্থাৎ পাঁচ গোষ্ঠী, কোট শব্দের অর্থ হল গোষ্ঠী। রাজবংশের নাম হয় শিখর রাজবংশ যদিও মধ্যযুগের একদম শেষের দিকে তারা সিংহদেও উপাধি ধারণ করে। এরপরে রাজধানী কয়েকবার বদল হয় এবং এই বংশের আরেক শাসক কীর্তিনাথশেখর দশম শতাব্দীতে এই গড়ের নির্মাণ করেন ও এখানে রাজধানী স্থাপন করেন। সেই থেকে শিখরবংশের রাজধানী পঞ্চকোটের গড় বা গড়পঞ্চকোট নামে পরিচিত হয়। তখন গোটা অঞ্চলটি ছিল বৃহৎ দূর্গে ঘেড়া এবং তার কেন্দ্রে ছিল রাজধানী।
দূর্গটি ছিল এক অর্ধবৃত্তাকার বিশাল পরিখাতে ঘেড়া যেটি নৌকাতেই পার করা যেত এবং তাতে কুমীরও ছাড়া থাকত। মূল দূর্গটি পুরু পাথরের দেওয়াল দিয়ে আবৃত থাকত ও তার বাইরে আরো একটি বিশাল প্রতিরক্ষাপ্রাচীরের অবস্থান ছিল। এছাড়াও স্থানে স্থানে থাকত watchtower। বর্তমানে সেই প্রাচীরগুলির কিছু ধ্বংসস্তুপ পড়ে আছে ও পরীখাটি এখন ক্ষুদ্র একটি জলাশয়রূপেই আছে। এছাড়াও আরো কিছু উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য হল রাণীমহল, পঞ্চরত্ন মন্দির, কঙ্কালেশ্বরী মন্দির, জোড়াবাংলা মন্দির, watchtower, প্রবেশপথ ইত্যাদি। এগুলি সবই এখন ধ্বংসস্তুপ ও সংস্কারের অভাবে বিলীন হবার উপক্রম। তবে পঞ্চরত্ন মন্দিরটি ইদানীং সংস্কার করা হয়েছে। কিন্তু কোন মন্দিরেই আর বিগ্রহ অবস্থান করেনা।
শিখররাজারা বৈষ্ণব, শাক্ত ও জৈনধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এইকারণে পঞ্চকোট রাজ্যে বৈষ্ণব, শাক্ত ও জৈন মন্দিরের সংখ্যাধিক্য দেখা যায়। অনেক মন্দির আবার নদীর তীর বরাবর স্থাপিত হত। মন্দিরগুলি পোড়ামাটি ও পাথর উভয়দ্বারাই নির্মিত হত। খোদ গড় পঞ্চকোটেই একসময়ে চল্লিশটির বেশী মন্দিরের উপস্থিতি ছিল।
এই রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, বর্ধমানের কিয়দংশে, সমগ্র পুরুলিয়া, ঝাড়খণ্ডের বোকারো, ধানবাদ, রাঁচী সিংভূমে। এছাড়াও কটক ও বারাণসীতে তাদের জমিদারী ছিল।
JD Beglar 1872 খ্রীষ্টাব্দে আঁখ দুয়ার, বাজার মহল দুয়ার, খড়িবাড়ি দুয়ার এবং দুয়ার বাঁধ নামক চারটি তোরণের বর্ণনা করেন। এর মধ্যে খড়িবাড়ি দুয়ার এবং দুয়ার বাঁধে মল্লরাজ বীর হাম্বীর মল্লদেবের নাম পাওয়া যায় যেটা থেকে এটাও ধারণা করা যায় যে তারা মল্লভূমের অধীনস্থ ছিলেন।
শিখররাজারা প্রজাহিতৈষী ছিলেন এবং নিষ্কর মৌজাদানের উদাহরণ পাওয়া যায় এই নিয়েও ঐতিহাসিকমহলের মত। বৃহৎ মানভূমের সংস্কৃতিকে তারা পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তাদের সভা অলঙ্কৃত করতেন কথাসাহিত্যিক থেকে সঙ্গীতশিল্পী থেকে নর্তক-নর্তকীরা। (এখানে নাচ বলতে মূলত ছৌনাচের কথাই বলা হয়েছে)
বাংলাতে বর্গী আক্রমণের সময়ে এই দূর্গনগরী বর্গীদের নজরে পরে ও হামলাতে এই নগরী সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত শ্মশানে পরিণত হয়। কথিত আছে, রাজার সতেরো রাণী সম্ভ্রম বাঁচাতে কুয়োতে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। অবশিষ্ট রাজবংশ কাশীপুরে প্রস্থান করে ও সেখানেই রাজধানী স্থাপন করে। সেখানেও ইতিহাস আছে, তবে তা অন্য পোস্টে বর্ণনা করা যাবে।
মারাঠা ধ্বংসলীলার জীবন্ত সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে এই গড় পঞ্চকোটের ধ্বংসস্তুপ। এককালে এইনগরী লোকজনে গমগম করত, রাজপাট বসত, দূরদূরান্ত থেকে বণিকরা আসত বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে। এখন এটি একটি পাহাড়ি ধ্বংসস্তুপ।
Author: Sayak Bhattacharya