
শুশুনিয়া পাহাড় পর্যটনপ্রিয় মানুষের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ। মূলত শীতকালে এখানে পর্যটকদের ঢল নেমে পড়ে। camping, rock climbing, trekking ছাড়াও মনোরম প্রকৃতির আস্বাদন করতে পর্যটকেরা এখানে আসেন।
তবে এই পাহাড়ের মূল গুরুত্ব পর্যটনের জন্য নয়, এটি মূলত ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্তিক অঞ্চল হিসাবে অসীম গুরুত্বপূর্ণ। এর কারণ এই অঞ্চল বাংলার সর্বপ্রাচীন অঞ্চলদের মধ্যে অন্যতম।
পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার ছাতনা শহরের কাছে এই পাহাড় অবস্থিত। ভূতাত্বিকভাবে বাংলার সবচেয়ে পুরনো ভূমি হল পশ্চিম রাঢ়, তারই অন্তর্গত এই শুশুনিয়া পাহাড়। শুশুকের আকৃতির জন্যে এই নামকরণ।
এই অঞ্চলে হায়না, জিরাফ, এশিয়াটিক সিংহ প্রভৃতি প্রাণীর জীবাষ্ম মিলেছে। এর মধ্যে এশিয়াটিক সিংহের গুরত্ব আলাদাই কারণ বাংলার রাজকীয় পশু যুগ যুগ ধরে ছিল এই এশিয়াটিক সিংহ।
প্রাণীর জীবাষ্ম ছাড়াও এখানে মিলেছে প্রস্তরযুগে ব্যাবহৃত যন্ত্রাদি ও অস্ত্র। প্রস্তরযুগের নানান সময়কালের(time period) অস্ত্রই এখানে মিলেছে। নুড়িপাথর, স্ফটিক, ফেল্সপার,জ্যাসপার, ব্যাসল্ট, ডোলোরাইট প্রভৃতি পাথরের তৈরী অস্ত্র, যন্ত্রাদি মিলেছে এখানে। কুঠার, ছুরি, তীরের ফলা, খননযন্ত্র, চাঁছনি, ওভেট, খননযন্ত্র, ছেদক ইত্যাদি যন্ত্রাদি পাওয়া গেছে। এই অঞ্চল সম্পূর্ণ বনজঙ্গলে আবৃত ছিল এবং নানান ধরণের তৃণভোজী, মাংসাসী প্রাণীর বিচরণ ছিল এখানে। আবার কাছেপিঠে নদী ও ঝর্ণা উভয়ের জলই প্রাপ্য ছিল। ফলে প্রস্তরযুগে বসবাসের জন্যে পর্যাপ্ত রসদ ছিল তাই সমগ্র প্রস্তরযুগ ধরেই মানুষের বসবাস ছিল। মূলত পশুর মাংস ও বুনোফল ছিল তাদের খাদ্য। শুশুনিয়ার পাদদেশের কাছাকাছি ত্রিশটি মত পুরাতাত্বিক কেন্দ্র অবস্থিত।
তবে শুধু প্রাগৈতাহিক যুগেই নয়, বাংলার ইতিহাসেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। এই শুশুনিয়া পাহাড়েই মিলেছে বাংলার প্রাচীনতম শিলালিপি- রাজা চন্দ্রবর্মার শিলালিপি। এই পাহাড়েই চন্দ্রবর্মার দূর্গের অবস্থান ছিল বলে অনেক ঐতিহাসিক অনুমান করেন। এর নিকটেই ছিল রাজধানী পুষ্করণা নগর। মালবদেশের দশপুর-মন্দসৌর লিপি যা হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কার করেন তা অনুসারে জয়বর্মার পুত্র সিংহবর্মা ও সিংহবর্মার দুই পুত্র- বড় চন্দ্রবর্মা ও ছোট নরবর্মা। এই বংশের আদি পরিচয়, নিবাস নিয়ে জল্পনা রয়েছে। কোনমতে তারা রাজস্থানের, কোনমতে আবার তাদের আদিনিবাস সিংহল। গুপ্তসম্রাট সমুদ্রগুপ্তের সভাকরি হরিসেন রচিত 'এলাহাবাদ প্রশস্তি' তে যে চন্দ্রবর্মার উল্লেখ আছে তা ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতানুসারে এই পুষ্করণারাজ চন্দ্রবর্মাই।
ধর্মে তারা ছিলেন বৈষ্ণব এবং বিষ্ণুকে নৃসিংহরূপেই উপাসনা করতেন। রাজার প্রভাবে এই অঞ্চলে মানুষদের মধ্যেও বৈষ্ণবধর্ম প্রসার ঘটে। শুশুনিয়া পাহাড়ে ওঠার ধাপের আগেই পাদদেশে একটি নৃসিংহ মূর্তি ও উপাসনাস্থল রয়েছে। আবার এর সামনেই রয়েছে একটি পাহাড়ি ঝর্ণা যেটি টাইলসে বাঁধানো ও জলের উৎসমূখে সিংহের মূখ বসানো রয়েছে। এই জলে ঔষধিগুণ আছে বলেও জনমানসে বিশ্বাস। এছাড়াও নরসিংহ নিয়ে বহু কিংবদন্তী স্থানীয় লোককথাতে প্রচলিত।
সেই চন্দ্রবর্মার আমলেই শুশুনিয়া পাহাড়ে খচিত হয় বাংলার প্রাচীনতম শিলালিপি। এই লিপির দুটি অংশ- উপরের অংশে দুটি সমান্তরাল বৃত্ত অবস্থান করছে। একটি বৃত্ত থেকে কতগুলি রেখা নির্গত হয়ে এসেছে, এই রেখাগুলি আবার আরেকটি বড় বৃত্ত দ্বারা আবৃত। অপর বৃত্তটি থেকে বেরিয়ে এসেছে অনেকগুলি অগ্নিশিখা। প্রতিটি অগ্নিশিখার পরেই আবার দুটি করে অর্ধবৃত্ত দিয়ে ঘেরা। এটি মূলত ভাবলিপি। এই ভাগটিকে বিষ্ণুচক্র বলে ধারণা করা হয়েছে।
নীচের অংশে ব্রাহ্মীলিপিতে নিম্নোক্ত কথা খোদিত আছে যা বন্ধনীতে বাংলা করে দেওয়া হল:
''পুষ্করণাধিপতে মহারাজ শ্রীসিঙ্ঘবর্মণঃ পুত্রস্য/ মহারাজ শ্রীচন্দ্রবর্মণ কৃতিঃ/ চক্রস্বামিন দাসাগ্রেণাতি সৃষ্টঃ’'
(পুষ্করণার অধিপতি মহারাজ শ্রীসিংহবর্মার পুত্র মহারাজ শ্রীচন্দ্রবর্মার কীর্তি। চক্রস্বামী অর্থাৎ বিষ্ণুর অগ্রদাসের দ্বারা সৃষ্ট।)
হয় রাজ্যবিজয় নয় ভূদান বা কোন গুরুত্বপূর্ণ কীর্তির স্মারক হিসাবেই এই লিপি খোদিত।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে এটি ‘দ্য ওল্ডেস্ট ব্রাহ্মি ইনস্ক্রিপশন ইন বেঙ্গল' এবং প, ম, হ, র প্রভৃতি কয়েকটি অক্ষর প্রায় আধুনিক বাংলা অক্ষরের মতো’।
এই অঞ্চলের কাছেই নেতকমলা ও বিকনা গ্রামদুটি ডোকরা শিল্পের জন্যে বিখ্যাত। এই ডোকরা শিল্প হল এক প্রাচীন শিল্প যার নিদর্শন সিন্ধ্যুসভ্যতা থেকে চীন, ভিয়েতনাম সর্বত্র পাওয়া যায়। সুপ্রাচীন এই শিল্প পশ্চিমবঙ্গেও প্রচলিত তার মধ্যে অন্যতম কেন্দ্র হল উপরোক্ত দুটি গ্রাম। এছাড়াও বর্ধমান, বাঁকুড়ার আরো কিছু স্থানে এই শিল্পের প্রচলন আছে। পাহাড়ের পাদদেশে যে হাট বসে তাতে এই শিল্পসামগ্রী পাওয়া যায়। এছাড়াও গ্রামে ডোকরামেলা অনুষ্ঠিত হয়। এই শিল্পের অবস্থা বর্তমানে সঙ্গীন। এই ডোকরা শিল্প নিয়ে পারলে পরে লিখব।
অতীতের সেই পুষ্করণা নগরী বর্তমানে পখন্না বা পোখরনা নামে একটি সাধারণ গ্রাম মাত্র।
এই অঞ্চলের ভূমি আদিম ও ঐতিহ্যবাহী। সঠিক উদ্যোগে ঐতিহাসিক, পুরাতাত্বিক গবেষণাকার্য হলে বাঙালীর ইতিহাসের আরো অনেক অধ্যায় বেরিয়ে আসবে তা সন্দেহাতীত। সুতরাং বাংলার ইতিহাস, পুরাতত্ব ও ঐতিহ্যের দিক দিয়ে এই অঞ্চল বাংলার এক অমূল্য সম্পদ।
Author: Sayak Bhattacharya