
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুরুলিয়া জেলার সদর পুরুলিয়া শহর থেকে 47 কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে রথুনাথপুর মহকুমার অন্তর্গত জলে নিমজ্জিত প্রত্নস্থল তেলকুপি। পাঞ্চেতে দামোদার নদীর উপর 1959 সালে বাঁধ তৈরীর সময় এই পুরাকেন্দ্রটি দামোদারের জলে নিমজ্জিত হয় এবং তার সাথে সলিলসমাধি ঘটে বাঙালীর ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের।
তেলকুপীর প্রাচীন নাম ছিল 'তৈলকম্পী'। তৈল অর্থাৎ কর ও কম্পন অর্থাৎ পরগণার সংযোগে এর নামকরণ যার অর্থ করদ প্রদেশ। এই তৈলকম্পী ছিল পঞ্চকোট রাজ্যের শিখরবংশীয় রাজাদের একটি প্রাচীন রাজধানী। আনুমানিক নবম থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত এর অস্তিত্ব ছিল বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের মত। এই বংশেরই একাদশ-দ্বাদশ শতকের এক রাজা রুদ্রশিখর তার বিভিন্ন সামন্তের সহযোগীতায় পালসম্রাট রামপালকে বরেন্দ্রভূমি পুনরুদ্ধারে সহায়তা করেছিলেন। তাদের এই গৌরবগাথা সন্ধ্যাকর নন্দীর 'রামচরিতম' এ বর্ণনা করা আছে:
''শিখর ইতি সমর পরিসর বিসর দরিরাজ
রাজিগত্ত গধ্বগহন দহন দাবানল:
তৈলকম্পীয় কল্পতরু রুদ্রশিখর''
(যুদ্ধে যার প্রভাব, নদী-পর্বত ও উপান্তভূমি জুড়ে বিস্তৃত, পর্বত কন্দরের রাজবর্গের যিনি দর্প দহনকারী দাবানলের মতো সেই তৈলকম্পের কল্পতরু রুদ্রশিখর।)
পঞ্চকোটের রাজবংশমালা অনুযায়ী রুদ্রশিখরের আবির্ভাব ঘটে 1098 সালে আবার ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন গুপ্তর মতে রামপালের শাসনকাল 1070-1120 খ্রীষ্টাব্দ। সুতরাং বাংলার ইতিহাসের একটা হারানো অধ্যায় এখানে পাওয়া যাবে।
রাজধানী হবার সাথে সাথে এটি ছিল তৎকালীন এক গুরত্বপূর্ণ বন্দরনগরী। এর কাছেই অবস্থিত ছিল দুটি তামার খনি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য রাঢ়বাংলা যুগ যুগ ধরেই তামা, কাঁসা, পিতলের দ্রব্য উৎপাদনে প্রসিদ্ধ। এই থেকে ঐতিহাসিকদের মত যে এই বন্দরনগরী দামোদার নদীপথের বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল এবং এই বাণিজ্যপথে বণিকরা তাম্রলিপ্ত বন্দরে বাণিজ্যসামগ্রী নিয়ে যেত যার মধ্যে তামা, কাঁসা, পিতল, পাথর, মৃৎশিল্প ও অন্যান্য সামগ্রী থাকত। বণিকরা মূলত জৈনধর্মাবলম্বী ছিল বলে ঐতিহাসিকদের মত। এর কারণ হল রাঢ়বাংলাতে জৈনধর্মের বিকাশ ঘটেছিল এবং বণিকদের মাঝে জৈনধর্ম ছিল জনপ্রিয়। তাছাড়া তেলকুপির মন্দিরগুলির অনেকগুলিই হল জৈনমন্দির ও হিন্দুমন্দিরগুলিতেই জৈনপ্রভাব পরিলক্ষিত হয়। মূলত বণিকদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই এই মন্দিরগুলি গড়ে বলে অনুমান করা হয়। পরবর্তীকালে জৈনধর্ম হ্রাস পাওয়াতে অনেক জৈন মন্দির হিন্দু মন্দিরে রূপান্তিরত হয় ও অনেক জৈন বিশ্বাস, আচার, ধর্মীয় চরিত্র হিন্দুদের মাঝে প্রবেশ করে। যেমন স্থানীয় অধীবাসীদের এক উপাস্য দেবতা হল বিরূপনাথ বা ভৈরবনাথ। এই ভৈরবনাথ আদতে জৈন তীর্থঙ্কর ঋষভদেব। পরবর্তীকালে স্থানীয় হিন্দুদের মধ্যে শিবের এক রূপ হিসাবে উপাস্যে পরিণত হন। কিছু কিছু স্থাপত্যে বৌদ্ধধর্মের প্রভাবও দেখা যায়।
এই মন্দিরসমূহ নিয়ে ঐতিহাসিক বিবরণগুলির মধ্যে বিখ্যাত হলঃ
1. ১৮৭৮ এ প্রকাশিত জে. ডি বেগলারের “Report of A Tour through the Bengal Provinces (Vol VIII)”।
2. ১৮৭৭ সালে প্রকাশিত হান্টারের "Statistical Account of Bengal (volume=XVII)"।
3. ১৮৯৬ সালে অবিভক্ত বাংলার পূর্ত বিভাগের দ্বারা সংকলিত বাংলার প্রাচীন সৌধের একটি তালিকা যা ৩১শে আগস্ট ১৮৯৫ পর্যন্ত সংযোজিত করা ছিল।
4. 1903 সালে বেঙ্গল সার্কেলের আর্কিওলজিকাল সার্ভেয়ার টি. ব্লচের বিবরণ।
5. নির্মলকুমার বসুর বিবরণ।
6. দেবলা মিত্রের বিবরণ।
7. এছাড়া ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় ও সুভাষ রায়ের বিবরণ।
এর মধ্যে বেগলারের বিবরণীতেই পুঙ্খানুপুঙ্গভাবে মন্দিরসমূহের বিবরণী আছে। বেগলারের মতে সেসময় ছোটনাগপুর সার্কেলের ভিতর তেলকুপী ব্যতীত এত স্বল্প পরিসরে এতগুলি উৎকৃষ্ট মানের মন্দির দেখা যায়নি। মন্দিরগুলি তিন ভাগে বিভক্ত ছিল। প্রথম ভাগের মন্দিরগুলি গ্রামের উত্তর দিকে নদীর কাছে অবস্থিত ছিল। দ্বিতীয় ভাগের মন্দিরগুলির অবস্থান ছিল গ্রামের কাছে; কিছুটা পশ্চিম দিকে। তৃতীয় মন্দির সমষ্টিগুলি ছিল দক্ষিণ পশ্চিম দিকে– গ্রামের শেষ প্রান্তে। প্রথম সমষ্টিতে তেরোটি মন্দির ছিল। দ্বিতীয় মন্দিরসমূহতে বেগলার ছটি মন্দির ও অনেক মূর্তি দেখেছিলেন, যার মধ্যে উনি চারটি মন্দিরকে উল্লেখযোগ্য মনে করেছিলেন। তৃতীয় মন্দিরশ্রেণীর মধ্যে বেগলার তিনটি মন্দির ও একটি মঠের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেছিলেন। এই শেষাক্ত মন্দিরশ্রেণীর আশেপাশে উনি অনেক পাথরের ও ইঁটের স্তুপ দেখতে পেয়েছিলেন। নিম্নে তার লিঙ্কটি দেওয়া হল বিস্তারিত জানার জন্যঃ
https://en.m.wikisource.org/wiki/Report_of_a_Tour_through_the_Bengal_Provinces/Telkupi
মন্দিরগুলির স্থাপত্যরীতি স্বকীয়তা ও নৈপুণ্যের পরিচয়বাহক। বড় পাথরকেটে উপযুক্ত আকার করে তারপর তা দিয়ে মন্দিরগুলি নির্মিত হত। কোন পেষণীযন্ত্রের প্রযোগ হতনা। তারপর পাথরের উপর ভাস্কর্য নির্মাণ হত। ছোট ফাঁকগুলি পাথর ও বড় ফাঁকগুলি করবেলিং পদ্ধতির মাধ্যমে ভরাট করা হত। মন্দিরগুলিতে একটিমাত্র খিলানযুক্ত প্রবেশপথ থাকত যাকে দেউল বলা হত।
বর্তমানে এই প্রত্নস্থলের পুরোটাই জলে নিমজ্জিত। 1959 সালে জলরাশির অতল গভীরে তলিয়ে গেল বাঙালীর ইতিহাসের এক অধ্যায়। কয়েকটি মন্দিরই টিকে আছে যার মধ্যে কিছু ভগ্নপ্রায় ও কিছু অক্ষত। গ্রীষ্কালের দাবদাহে জল শুকোলে কিছু মন্দিরের চুড়া দেখা যায়। একটি মন্দির অর্ধনিমজ্জিত ও তা নৌকার সাহায্যে গিয়ে দেখতে হয়। এছাড়া ইতস্ততভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু অবশিষ্ট দেউল, কিছু বিগ্রহ, ইঁটের ভগ্নস্তুপ ইত্যাদি।
এই তেলকুপি কী অন্য কিছুরও সংকেত দেয়? বাঙালীর ইতিহাস নিমজ্জিত হয়ে অতল গভীরে হারিয়ে যাওয়ার করুণ কাহিনীর সাক্ষী হয়ে আছে আজকের তেলকুপী। তবে জলের মধ্যে থেকেও চুড়ো তুলে থাকা কিছুটা আশার উদ্রেক করে।
Author: Sayak Bhattacharya