
শাহী বাঙ্গালা সালতানাতে অসংখ্য সুদক্ষ সুলতান ও বীর সেনাপতির আগমন ঘটেছে। তবে আসাম থেকে উড়িষ্যা পর্যন্ত কিংবদন্তিতে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে বাংলার যে সেনানায়কের নাম, তিনি হলেন কালাপাহাড়। সাহিত্য কিংবা সিনেমা, লোকমুখে প্রচলিত মিথ বা কিংবদন্তি সব কিছু ছাপিয়ে যাঁর নাম আজও বিখ্যাত হয়ে রয়েছে যে মহান বীরের নাম, তিনি আর কেউ নন, তিনিই কালাপাহাড় । কে ছিলেন কালাপাহাড়? কেনই বা তার নামে এতো কিংবদন্তী তুল্য উপাখ্যান?
আজ আলোচনা করবো সে কথাই, আজ আলোচনা করতে চলেছি "বঙ্গ রক্ষক" কালাপাহাড় সম্পর্কে।
কালাপাহাড় বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী মতান্তরে নওগাঁ জেলার বীরজোয়ান গ্রামে সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ভাদুড়ি বংশের সম্ভ্রান্ত বারেন্দ্রী ব্রাহ্মণ। তাঁর বাল্যনাম ছিলো রাজীবলোচন রায় মতান্তরে কালাচাঁদ রায়- ডাকনাম ছিলো রাজু। রাজু ভাদুড়ী হিসেবেই পরিচিত ছিলেন কালাপাহাড়। তাঁর পিতা নয়নচাঁদ রায় ছিলেন বাংলার সুলতানের অধীনস্থ ফৌজদার। অকালে পিতৃহারা হয়ে রাজীবলোচন রায় ভাদুড়ি ভাগ্যের সন্ধানে সুলতান সুলায়মান শাহ'র সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই মেধা ও সমরকুশলতায় সুলতান ও অন্যান্য পদস্থ কর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে উচ্চপদে নিযুক্তি লাভ করেন। ধর্মপ্রাণ ব্রাহ্মণ ছিলেন রাজু,, নিয়মিত বিষ্ণুপূজা করতেন। সুদর্শন কালাপাহাড়ের সাথে সুলায়মান শাহ কারলানীর সুন্দরী কন্যা দুলারী বিবির প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দুলারী বিবি পিতার কাছে কালাপাহাড় কে বিবাহ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কালাপাহাড় শাহজাদীকে বিবাহ করার জন্য ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হন ও মুহাম্মাদ ফর্ম্মুলী নাম ধারণ করেন। কালাপাহাড়ের সাথে দুলারী বিবির শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়। তিনি অচিরেই সুলায়মান শাহ'র প্রধান সেনাপতি পদ লাভ করেন।
কালাপাহাড় মুসলিম হওয়ায় বর্ণবাদী উগ্র ব্রাহ্মণ সমাজ তাকে সমাজচ্যুত করে । তিনি ইসলাম গ্রহণের পরও তাঁর বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-পরিজনের সাথে সৌহার্দ্য বজায় রাখবার চেষ্টা করলেও ধর্মান্তরের কারণে হিন্দু সমাজ তাঁকে পরিত্যাগ করে, বারংবার তাঁকে অপদস্থ হতে হয়।
এমতাবস্থায় নিজ জাতি কর্তৃক অপমানে জর্জরিত হয়ে শেষমেশ তিনি মায়ের পরামর্শে পদ-পদবী, ক্ষমতা, প্রিয়তমা নবপরিণিতা স্ত্রীর ভালোবাসা , রাজবংশের জামাতার সম্মান, জীবন-মৃত্যুর ভয়, শাস্তি সবকিছু উপেক্ষা করে প্রায়শ্চিত্তের জন্য পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে গমন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু জগন্নাথ ধামের পুরোহিতরা তাকে অত্যন্ত জঘন্য ভাষায় অপমান করে তাকে দেবালয়ে প্রবেশ করতেই দেয় নি। ব্রাহ্মণ্যবাদী উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা অপমানিত-অপদস্থ হয়ে কালাপাহাড়ের মনে হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে তীব্র বিদ্বেষের সৃষ্টি হয়। ধীরে ধীরে হিন্দু রীতি-নীতি সম্পর্কে তাঁর মনে জন্ম নেয় তীব্র ঘৃণা। তিনি প্রচণ্ড হিন্দু ধর্মবিদ্বেষী হয়ে ওঠেন...…।
বাংলায় তখন চলছে পাঠান কারলানী রাজবংশের শাসন, তান্ডার সিংহাসনে আসীন সুলতান সুলায়মান শাহ্ কারলানী (রহ.)
উড়িষ্যার সিংহাসনে তখন পরাক্রমশালী সম্রাট মহারাজ গজপতি হরিচন্দন মুকুন্দদেব। গজপতি হরিচন্দন মুকুন্দদেবের একের পর এক আক্রমণ আসছে দক্ষিণ ভারতীয় সালতানাত ও বাংলার উপর। তান্ডা দখলের অভিপ্রায়ে বারবার সপ্তগ্রামে আক্রমণও করেছেন উড়িষ্যারাজ। এইভাবে শাহী বাঙ্গালাহ্'র সার্বভৌমত্ব তখন উড়িয়া গজপতিদের কাছে হুমকির মুখে। বাংলা সালতানাত বারবার হুমকির মুখে পড়ছে উড়িয়া হিন্দুদের। উড়িয়াদের একের পর এক হানায় বাংলার মুসলিম সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। বাংলার মুসলিম শাসনকে রক্ষার জন্য মুশরিক শক্তির বিরুদ্ধে আবির্ভূত হলেন যে মহামানব, তিনিই কালাপাহাড়।
১৫৬৪-৬৫ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আকবরের বশ্যতা স্বীকার করে নেন ও উড়িষ্যার গজপতি হরিচন্দন মুকুন্দদেব গৌড় আক্রমণ করে গঙ্গার তীরে অবস্থিত সপ্তগ্রাম অধিকার করে নেন। ১৫৬৫ সালে ত্রিবেনীর যুদ্ধে পরাজিত হলেন সুলায়মান শাহ কারলানী, সন্ধি করতে বাধ্য হলেন মুকুন্দদেবের সাথে।
বাদশাহ আকবর যখন মেবারের শিশোদীয় রাজপুতদের সঙ্গে দীর্ঘকাল যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন, সুলায়মান শাহ ১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দে উড়িষ্যা আক্রমণ করেন। মুকুন্দদেব কোটসামা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করলে সুলায়মান শাহ্ কালাপাহাড়ের অধীনে ময়ূরভঞ্জের অরণ্যসংকুল পথে উড়িষ্যা আক্রমণ করতে সৈন্য পাঠান।
এইসময় মুকুন্দদেব তার এক বিদ্রোহী সামন্তের হাতে নিহত হন, এর ফলে ওই বিদ্রোহী সামন্ত এবং রঘুভঞ্জ ছোটরায় উড়িষ্যার সিংহাসন দখল করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু উভয়েই কালাপাহাড় কর্তৃক পরাজিত ও নিহত হন।
১৫৬৮ সালে মহাপরাক্রান্ত সম্রাট গজপতি মুকুন্দদেবকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও পৃথিবী থেকে গজপতিদের সমূলে উৎখাত করে চিরস্থায়ীভাবে উড়িষ্যা বিজয় করেন কালাপাহাড়। এরপর ১৫৭৬ সালে রাজমহলের যুদ্ধে সম্রাট দাউদ শাহ্ কারলানীর পরাজয়ের পর্যন্ত আর কখনো উড়িষ্যা বাংলা সালতানাতের হাতছাড়া হয় নি!
উড়িষ্যা জয় করে কালাপাহাড় উপস্থিত হলেন পুরীর কুখ্যাত জগন্নাথ মন্দিরে। দেবালয়ে প্রবেশ করেই পূর্বের স্মৃতি মনে পড়লো কালাপাহাড়ের। ইসলাম গ্রহণের অপরাধে কী নিদারুণ যাতনা ভোগ ও অপমানের শিকারই না হতে হয়েছিলো তাঁকে!! কেউ তাকে গ্রহণ করেনি,কেউ না! বাংলার ব্রাহ্মণ্যবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত মহাবীর কালাপাহাড়।
প্রতিশোধ গ্রহণের তীব্র স্পৃহা ও ব্রাহ্মণ্যবাদী বিভাজনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন কালাপাহাড়। জগন্নাথ মন্দিরে প্রবেশ করে গরুর চামড়ার বিশাল ঢোল হাতে নিয়ে বাজাতে লাগলেন। ঢোলের তীব্র শব্দে মন্দিরের বিগ্রহগুলো খসে খসে পড়তে লাগলো। বাঙ্গালীবীরের তীব্র ঢোলের আওয়াজে ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তির অন্তরাত্মা ক্রন্দন করে উঠলো। এককালে অপমানিত হয়েছিলেন যেই মন্দিরে, সেই জগন্নাথ মন্দির তছনছ করে দিলেন কালাপাহাড়। উড়িষ্যার সকল মন্দিরে ধ্বংসযজ্ঞ চালালেন তিনি। ময়ূরভঞ্জের মন্দির, কোনার্কের সূর্য মন্দিরের সকল দেবালয় উপড়ে ফেলেন কালাপাহাড়।
জগন্নাথ নামে কথিত দেবতার মূর্তি চিল্কা হ্রদে নিক্ষেপ করলেও
জগন্নাথের কোনো অভিব্যক্তি দৃশ্যমান হলোনা!
তিনি কোচরাজ বিশ্বসিংহের পুত্র বিখ্যাত সমরনায়ক শুক্লধ্বজ কে পরাজিত ও বন্দি করেন এবং কোচরাজ্যসহ কামরূপের তেজপুর পর্যন্ত অধিকার করে বাঙলার অন্তর্ভুক্ত করেন ।
কালাপাহাড়ের মন্দির ধ্বংসের কৌশল ছিলো অন্য রকম। তিনি দেবালয়ে প্রবেশ করে একটি গরুর চামড়ার তৈরি ঢোল নিয়ে প্রচন্ড শব্দে বাজাতেন। সেই বিকট আওয়াজে প্রতিমাগুলো খসে খসে পড়তো। এই আওয়াজ মু-শ-রি-ক রাজশক্তির বিরুদ্ধে ইসলামের রাজনৈতিক বিজয়ঘোষণাস্বরূপ।
অতঃপর সমস্ত ধন-রত্ন লুট করে কালাপাহাড় চলে যেতেন।
কালাপাহাড়ের আসাম জয়ের সময় ইতিহাসের এক অভিনব পুনরাবৃত্তি ঘটে। প্রায় দুই শতাব্দী পূর্বে ১৩৫৬ সালে শাহ-ই-বাঙ্গালিয়ান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের কামরূপ জয়ের সময় আসামের কামাখ্যা মন্দিরের সীতাযোনীপূজারীরা ধারণা করেছিলো, তাদের পূজ্য সীতাযোনীর কারণেই ইলিয়াস শাহ কামরূপ দখল করতে পারবেন না , তাদের সেই ধারণা সেদিন ব্যর্থ হয়েছিলো....কালাপাহাড়ের আসাম অভিযানেও তারা একই চিন্তা করলো যে, সীতাযোনিমূর্তির জন্যই কালাপাহাড় আসামের কিছুই করতে পারবেন না। এবারো পূজারীদের আশায় নিরাশ হতে হলো। গাজী কালাপাহাড় কামাখ্যা মন্দিরে ভাঙচুর চালালেন...
সুলায়মান শাহ-এর মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র বায়াজিদ শাহ সিংহাসনে বসলেও আমির ওমরাহ তার অযোগ্যতার কারণে তাঁ কে হটিয়ে কনিষ্ঠ পুত্র দাউদ শাহ কররানীকে সিংহাসনে বসান। দাউদ শাহ-এর সার্বক্ষণিক সহচর ছিলেন কালাপাহাড়।
রাজমহলের যুদ্ধ:
১৫৭৫ সালের তুর্কাইয়ের যুদ্ধে দাউদ শাহ্ পরাজিত হলে বিহার-বাংলা মুঘলদের অধীনে চলে যায়, কররানী দের নিয়ন্ত্রণে থাকে কেবল উড়িষ্যা। কিন্তু তান্ডায় প্লেগ ছড়িয়ে পড়লে ৫০০০ সৈনিক ও ১৫ জন সেনাপতিসহ সুবাদার মুনিম খান মৃত্যুবরণ করলে এই সুযোগে কালাপাহাড় কে সঙ্গে নিয়ে উড়িষ্যা থেকে গৌড় পর্যন্ত প্রতিটি দুর্গ অধিকার করেন দাউদ শাহ। অন্যদিকে দাউদ শাহর ডানহাত ভাটির রাজা ঈসা খাঁ তাঁর শক্তিশালী নৌবহর দিয়ে হামলা চালিয়ে পূর্ববাঙলাকে মুঘল নিয়ন্ত্রণমুক্ত করেন।
আকবর খান জাহান হোসেইন কুলী খান তুর্কমান কে পাঠান দাউদ শাহকে দমনের জন্য। বাবা খান কাকশাল,ইসমাইল বেগ, জান বাহাদুর বাহসুতী, রাজা গোপাল, রাজা তোডরমল, শাহাম খান, কিয়া খান, মোজাফফর হোসেন খান তুর্বাতী প্রমুখ বড় বড় মানসাবদারদের নিয়ে ৯১ হাজার সৈন্যসহ রাজমহলের প্রান্তরে গঙ্গার তীরে উপস্থিত হয় মুঘল বাহিনী। দীর্ঘ আটমাস তোপযুদ্ধে কেউ কারোর ক্ষতি করতে না পারলেও ১১ই জুলাই রাতে বিশ্বাসঘাতক কুতলু খান লোহানি মুঘলদের জানিয়ে দেয়- সাইফ-ই-পাখতুন ফৌজ জুনায়েদ খান কররানী আজ প্রচন্ড গরমের কারণে সেনাশিবিরের বাইরে চারপায়ার উপরে ঘুমুচ্ছেন। সঠিক জায়গায় তোপ দাগে মুঘল ফৌজ। গোলার আঘাতে উড়ে যায় জুনায়েদ খান কররানীর একটি পা।
পরের দিন ১২ই জুলাই বিশ্বাসঘাতক শ্রী হরি ও কুতলু খান লোহানির প্রেরিত তথ্যের ভিত্তিতে মুঘলরা গঙ্গানদী পেরিয়ে বাংলার বাহিনীকে আক্রমণ করতে সক্ষম হয়।
বাবা খান কাকশাল অতর্কিতে কালাপাহাড়কে আক্রমণ করে বসেন। কালাপাহাড় বাবা খান কাকশালের বাহিনীকে বিধ্বস্ত করে দেন।
সবাই ভেবেছিলো প্রচন্ড আহত হওয়ায় জুনায়েদ খান যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। কিন্তু সবাই হতবাক হয়ে দেখলো, একটি পা উড়ে যাবার পরেও জুনায়েদ হাতির পিঠে চড়ে লড়াই করছেন ও বিহারের মুঘল সুবাদার মোজাফফর হোসেন খান তুর্বাতীর বাহিনীকে বিধ্বস্ত করে দেন। কিন্তু ক্রমশ প্রচন্ড রক্তক্ষরণ হতে থাকলে হাওদাপৃষ্ঠে লুটিয়ে পড়েন জুনায়েদ, শহীদ হলেন সাইফ-ই-আফগান ফৌজ জুনায়েদ খান কররানী। তাঁর মৃত্যুতে বাংলার পরাজয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়।
এমন ক্রান্তিকালে রণাঙ্গন ছেড়ে নিজেদের বাহিনীসহ চলে যায় কুতলু খান লোহানী ও শ্রী হরি বিক্রমাদিত্য। ফলে বাংলার বাহিনী ব্যাপক দুর্বল হয়ে পড়ে। যুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত জেনে কালাপাহাড় নিজে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করেন ও সুলতান দাউদ শাহ কে পালানোর জন্য তাগাদা দিতে থাকেন। বীরদর্পে আগ্রাসী দখলদার হিন্দুস্তানী ফৌজের বিরুদ্ধে লড়াই করেন দাউদ শাহ।
আবুল ফজলের ভাষায়-
[ সেই উগ্র সিংহ প্রবল বিক্রমে অনেককেই আহত ও নিহত করলেন। যদি তিনি কোনো অশ্বারোহীকে আঘাত করছিলেন, তাহলে ঘোড়াসহ সেই অশ্বারোহীকে তিনি দ্বি-খণ্ডিত করছিলেন। যখনই তিনি কাউকে আঘাত করছিলেন তার মাথা তার পায়ের কাছে পড়ছিলো ]
শেষে দাউদ শাহ পালাতে সম্মত হন। কিন্তু, প্রচণ্ড যুদ্ধে সুলতানের ঘোড়াও নিহত হয়েছিলো। তখন দাউদ শাহর এক চাকর দালিত বাদাখনী সুলতানকে নিজের ঘোড়া প্রদান করলো ও জঘন্য বিশ্বাসঘাতকতা করে সুলতান কোন পথে যাচ্ছেন তা মুঘলদের জানিয়ে দিলো। সুলতান বেশিদূর যেতে পারলেন না। একটি পার্বত্য নদীর কাছেই ধৃত হলেন সুলতান। তাঁকে হাজির করা হলো খান জাহানের সামনে।
খান জাহান হোসেন কুলী খান তুর্কমানের প্রতি আকবরের নির্দেশ ছিলো দাউদ শাহ যদি আকবরের বশ্যতা স্বীকার করে নেন, তাহলে তিনি বাংলার সুবাদার হিসেবে নিযুক্ত হবেন।
দাউদ শাহকে খান জাহান বললেন- বাদশাহ আকবরের বশ্যতা স্বীকার করে নিন।
কিন্তু বাংলার সার্বভৌম সম্রাট যিনি, তিনি কি আর হিন্দুস্তানের অধীনতা মানতে পারেন!
দাউদ শাহ উদ্ধতস্বরে জবাব দিলেন- "বাংলার বাদশাহ আসমানের বাদশাহ ব্যতীত অন্য কারো সামনে মাথা নত করে না।"
দাউদ শাহের মাথা তীক্ষ্ণ তলোয়ার দিয়ে কেটে ফেলা হলো। দাউদের রক্তে বাংলার মাটি লাল হয়ে গেলো। বাঙ্গালার সার্বভৌমত্ব লুপ্ত হলো।
বাংলা সালতানাতের পতনের পর বাংলা নামেমাত্র মুঘল সাম্রাজ্যের প্রদেশে পরিণত হয়, ছড়িয়ে পড়ে বিদ্রোহ। উড়িষ্যায় গাদ্দার কুতলু খানকে রাজত্ব দেয়া হয়,সুন্দরবনে গাদ্দার শ্রীহরি ও তার ভাই বসন্ত রায়কে রাজত্ব দেয়া হয়। বেশিরভাগ অংশ স্বাধীন হয়ে যায়। ভাটির রাজা ঈসা খাঁ বিদ্রোহের লাল ঝান্ডা উত্তোলন করেন। সকল ভূস্বামী ও আফগান দলপতিরা ঈসা খাঁর অধীনে যোগ দিতে থাকেন।
আকবর দ্বীন-ই-ইলাহি প্রবর্তন করে সরাসরি মুর্তাদ হয়ে গেলে আকবরের অনেক সেনানায়ক বিদ্রোহ করেন এবং ভাটিরাজ ঈসা খাঁর কাছে আশ্রয় নেন।
মাসুম খান কাবুলির সাথে আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে যোগদান করেন কালাপাহাড়। আজীবন হিন্দুস্তানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন কালাপাহাড়।
১৫৮৩ সালের ৪ এপ্রিল বিহারে মুঘল বাহিনীর সাথে যুদ্ধে শহিদ হন কালাপাহাড় (রহঃ)
বাংলা থেকে ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তিকে সমূলে উৎখাত করার জন্য সারাজীবন লড়ে গেছেন কালাপাহাড় (রহঃ), মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে দিল্লীর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন বাঙলার স্বাধীনতার জন্য।
২০০৬ সালে উগ্রবাদী হিন্দুরা বিহারে কালাপাহাড় ও তাঁর সহযোদ্ধাদের সমাধি ধ্বংস করে দেয়।
লেখক:- রাজিত তাহমীদ জিত
০৯.০৮.২০২২
তথ্যসূত্র- (১) উড়িষ্যা-কামরূপ বিজয়ী বাঙালি বীর 'কালাপাহাড়' - সরদার আব্দুর রহমান
(২) তারিখ-ই-সালাতিন-ই আফগানা /তারিখ-ই-শাহী - আহমেদ ইয়াদগার
(৩) তারিখ-ই-দাউদী- আব্দুল্লাহ
(৪) তারিখ-ই-বাঙ্গালাহ- মুফতি সলিমউল্লাহ
Author: Rajit Tahmid Jeet